চিঁড়ে ফলার ও চিঁড়া দধি মহোৎসব
আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা দিলেই কবিদের মন উড়ুউড়ু হয়ে যায় , প্রেমিক-প্রেমিকাদের চিত্ত হয়েওঠে চঞ্চল, আর সুগৃহিণীদের মন হয় উদ্বিগ্ন ,তারা ভাড়ার-ঘর বা ফ্রিজের সঞ্চিত পুঁজির দিকে একবার চোখবুলিয়ে নেন, কারণ একটানা বৃষ্টিতে গৃহবন্দী হলে ওরাই ভরসা। এমতবস্থায় রাতে-দিনে খিচুড়ি দিয়ে চালিয়ে নিলেও জলখাবারে কি করবেন ভাবছেন ? সবদিন না হলেও মাঝে মাঝে ফলার খাওয়াই যায়।
যাঁরা জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রতি মঙ্গলবার জয় মঙ্গলবারের ব্রত পালন করেন তাঁরা জানেন যে চিঁড়ে ও মুড়কির সাথে দই, চিনি, ক্ষীর এবং পাকা আম, কাঁঠাল, কলা প্রভৃতি ফল সহযোগে তৈরী উপাদেয় খাবারটি কিন্ত বেশ কুলমর্যাদাসম্পন্ন।
চৈতন্যচরিতামৃত থেকে জানা যায় যে ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে পানিহাটিতে নিত্যানন্দপ্রভুর আগমন উপলক্ষে, সপ্তগ্রামের রাজা গোবর্ধন মজুমদারের একমাত্র পুত্র ও শ্রীচৈতন্যদেবের পার্ষদ ষঢ়-গোস্বামীর মধ্যে অন্যতম ভক্ত বৈষ্ণবকুল-চুড়ামণি রঘুনাথদাস গোস্বামী কাঁচা-ফলারের আয়োজন করেন যা ‘চিঁড়াদধিমহোৎসব’ নামে খ্যাত। সেই উৎসবে প্রচুর পরিমাণ চিঁড়ে, দই, দুধ, সন্দেশ ও কলা ভক্তদের মধ্যে পরিবেশিত হয়েছিল। আশেপাশের গ্রাম থেকে অসংখ্য ব্রাহ্মণ এবং সজ্জন ব্যক্তিরা সমবেত হয়েছিল সেই উৎসবে । অপ্রত্যাশিতভাবে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুও সেদিন সেখানে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সেই চিঁড়া-দধি ভোজন উৎসবটি দেখে সকলেরই মনে হচ্ছিল যে শ্রীকৃষ্ণেরই বনভোজন-লীলায় তাঁর সখাগণ চারিদিক থেকে এসে মিলিত হয়েছেন। আজও জৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে সশ্রদ্ধ-চিত্তে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় পানিহাটিতে এই চিড়া-দধি-দন্ড-মহোৎসব পালন করেন।
কিন্ত মনে প্রশ্ন জগতেই পারে “কে এই রঘুনাথ গোস্বামী আর কেন এই দন্ড-মহোৎসব। “..
সপ্তগ্রামের রাজার একমাত্র পুত্র শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামী ( মজুমদার ) পিতার বিপুল ঐশ্বর্য হেলায় পরিত্যাগ করে, অপ্সরার মতো রূপসী পত্নী কে ত্যাগ করে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অনুগামী হওয়ার মানসে বার বার তাঁর কাছে ছুটে যান , কিন্তু বাড়ির অমতে আসার জন্য, মহাপ্রভু তিন তিন বার তাকে বাড়ি বলেন ফিরে গিয়ে গৃহকর্মে মন দিতে। শেষবার বাড়ি ছেড়ে পুরিতে মহাপ্রভুর কাছে গেলে তিনি বলেন – নিত্যানন্দ প্রভু হচ্ছেন আদি গুরু, তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে পেতে হলে তাঁর প্রতিনিধি শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর মাধ্যমে পেতে হবে।
একবার স্বপরষদ নিত্যানন্দ প্রভু পানিহাটিতে এসেছেন, গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহ থেকে বাঁচতে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করছেন, এমন সময় ভক্ত রঘুনাথকে দূর থেকে চোরের মতো দণ্ডবৎ প্রণাম করতে দেখে, নিতাই সহাস্যে তাকে কাছে টেনে এনে বললেন –
“আইস,চোরা ভাগ দূরে দূরে।
আজি লাগ পাইয়াছি,
দন্ডিমু তোমারে।
চিড়া দধি ভক্ষণ করাহ মোর গণে।”
মহাপ্রভুর উপদেশ অমান্য করার অপরাধের দণ্ড স্বরূপ এই চিঁড়া-দই উৎসবের সূচনা। সেইজন্য একে দণ্ড মহোৎসব বলা হয়।
রঘুনাথ দাসের পর পানিহাটী নিবাসী রাঘব পণ্ডিত এই উৎসব করতেন । পরবর্তী কালে পানিহাটীর সেন পরিবার এই উৎসব করেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও কয়েকবার এই উৎসবে যোগদান করেন একথা কথামৃততে পাওয়া যায়।
পেনেটীর মহোৎসবে-ভক্তসঙ্গে সঙ্কির্তনানন্দে পৃষ্ঠা ২২৩
” ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পেনেটীর মহোৎসবক্ষেত্রে রাখাল, রাম, মাস্টার,
ভবনাথ প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
প্রথম পরিচ্ছেদ
১৮৮৩, ১৮ই জুন
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পেনেটীর মহোৎসবক্ষেত্রে বহুলোকসমাকীর্ণ রাজপথে সংকীর্তনের দলের মধ্যে নৃত্য করিতেছেন। বেলা একটা হইয়াছে। আজ সোমবার, জ্যৈষ্ঠ শুক্লা ত্রয়োদশী তিথী, ১৮ই জুন, ১৮৮৩।
সংকীর্তনমধ্যে ঠাকুরকে দর্শন করিবার জন্য চতুর্দিকে লোক কাতার দিয়া দাঁড়াইতেছে। ঠাকুর প্রেমে মাতোয়ারা হইয়া নাচিতেছেন, কেহ কেহ ভাবিতেছে, শ্রীগৌরাঙ্গ কি আবার প্রকট হইলেন! চতুর্দিকে হরিধ্বনি সমুদ্রকল্লোলের ন্যায় বাড়িতেছে। চতুর্দিকে হইতে পুষ্পবৃষ্টি ও হরির লুট পড়িতেছে।
নবদ্বীপ গোস্বামী প্রভু সংকীর্তন করিতে করিতে রাঘবমন্দিরাভিমুখে যাইতেছিলেন। এমন সময়ে ঠাকুর কোথা হইতে তীর বেগে আসিয়া সংকীর্তন দলের মধ্যে নৃত্য করিতেছেন।
এটি রাঘব পণ্ডিতের চিঁড়ার মহোৎসব। শুক্লাপক্ষের ত্রয়োদশী তিথীতে প্রতিবর্ষে হইয়া থাকে। দাস রঘুনাথ প্রথমে এই মহোৎসব করেন। রাঘব পণ্ডিত তাহার পরে বর্ষে বর্ষে করিয়াছিলেন। দাস রঘুনাথকে নিত্যানন্দ বলিয়াছিলেন, ‘ওরে চোরা, তুই বাড়ি থেকে কেবল পালিয়ে পালিয়ে আসিস, আর চুরি করে প্রেম আস্বাদন করিস-আমরা কেউ জানতে পারি না! আজ তোকে দণ্ড দিব, তুই চিঁড়ার মহোৎসব করে ভক্তদের সেবা কর।’
ঠাকুর প্রতি বৎসরই প্রায় আসেন, আজও এখানে রাম প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে আসিবার কথা ছিল। রাম সকালে কলিকাতা হইতে মাস্টারের সহিত দক্ষিণেশ্বরে আসিয়াছিলেন। সেইখানে আসিয়া ঠাকুরকে দর্শন ও প্রণামান্তর উত্তরের বারান্দায় আসিয়া প্রসাদ পাইলেন। রাম কলিকাতা হইতে যে গাড়িতে আসিয়াছিলেন, সেই গাড়ি করিয়া ঠাকুরকে পেনেটীতে আনা হইল। ”
এই প্রসঙ্গে মনে পরে গেলো, শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য প্রভুর কৃপাধন্য এই গৃহত্যাগী ভক্ত রঘুনাথ একবার তার পর্ণকুটিরে ভাগবত পাঠকরে শুনিয়েছিলেন মহাপ্রভুকে। ১৫৩৫-৫০ সালে লেখা বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবতে পাওয়া যায় :
হেনমতে পানিহাটি গ্রাম ধন্য করি।
আছিলেন কথোদিন শ্রী গৌরাঙ্গ হরি।।
তবে প্রভু আইলেন বরাহ নগরে।
মহাভাগ্যবন্ত এক ব্রাহ্মণের ঘরে।।
সেই বিপ্র বড় সুশিক্ষিত ভাগবতে।
প্রভু দেখি ভাগবত লাগিলা পড়িতে ।।
ভাবাবেগে আপ্লুত মহাপ্রভু রঘুনাথ গোস্বামীকে ‘”ভাগবতাচার্য্য” উপাধি দেন।
কলকাতার প্রাচীন জনপদ বরানগরের সেই পর্ণকুটির আজ বরানগর পাঠবাড়ী নামে প্রসিদ্ধ যা একই সঙ্গে দুজন যুগপুরুষের আশীর্বাদধন্য , শ্রীচৈতন্য এবং শ্রীরামকৃষ্ণ।
গঙ্গাতীরস্থ যে পর্ণকুটিরে শ্রীচৈতন্য পদার্পন করেছিলেন সেখানে তাঁর পাদুকা আজ ও সংরক্ষিত আছে; এছাড়াও আছে বৈষ্ণব সমাজের বহু প্রাচীন ও দুষ্প্রাপ্য পুঁথি।
দেখেছেন, কথা শুরু হয়েছিলো সাধাসিধে স্বাত্তিক গোছের ‘ফলার’কে নিয়ে, আর আমার গল্প আপনাদেরকে সঙ্গে নিয়ে পুরোনো কলকাতার অলিগলি ঘুরে একেবারে শহরতলিতে পৌঁছেগেল।
এতদূর যখন গেলাম তখন সীমানা ছাড়িয়ে আরেকটু এগোই ?
অসম, হ্যাঁ এই রাজ্যেও ফলার বেশ সমাদৃত।
‘বঙালী বিহু ‘ বা অহমিয়া নববর্ষের দিনে সকালে এই ফলার দিয়েই অথিতি-আপ্যায়ন করার রীতি প্রচলিত আছে। তবে এখানে ফলারকে বলাহয় “জলপান”। না না সুকুমার রায়ের অবাক জলপান নয়; এ একেবারেই অহমিয়া জলখাবার।
এবার বলুনতো যাকে নিয়ে এত গল্প, এতো ইতিহাস সেকি যে সে খাবার ??? এবার থেকে ওকে একটু সুনজরে দেখবেন তো ?
আপনাদের জন্য একটু ফলার/জলপান/চিঁড়া-দধি পাঠালাম ; ইচ্ছে হলে চেখে দেখবেন 🙂
Photo courtesy :
Arindam Das ( Baranagar Pathbari )
Panihati municipality ( dondo mohothav )
বৃন্দাবনদাস প্রসঙ্গ : শ্রী অমিতাভ পুরকায়স্থ