জাগো দূর্গা
বাজারে ইলিশ আর আকাশে কালো মেঘ মনে করিয়ে দিচ্ছে , আশ্বিনের এখনো ঢের দেরি , তবুও রথযাত্রার দিন কাঠামো-পুজো হওয়া মাত্রই আমাদের মধ্যে কেমন যেন সাজসাজ রব পড়ে যায় আসন্ন দুর্গোৎসবের l
অশ্বিনের শারদপ্রাতে হয় দেবীপক্ষের সূচনা ও মাতৃ-আরাধনা l দেবীর বোধন, নবপত্রিকা স্নান, সন্ধি-পুজো, কুমারী পুজো প্রভৃতি বিভিন্ন উপাচারে হয় মাতৃ বন্দনা l
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-কথামৃতে, ঠাকুর বলেছেন, :
“ কুমারীপূজা করে কেন ?
সব স্ত্রীলোক ভগবতীর এক একটি রূপ। শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর বেশী প্রকাশ।”
তাঁর সুযোগ্য শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দও ছোটছোট শিশুকন্যা দের জগন্মাতা রূপ হিসেবে ‘কুমারী’ রূপে পুজো করেছেন l
নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের লোকশিক্ষা পরিষদের স্টলে একটা ছোট বই হঠাৎ নজরে পরে, বই না বলে তাকে পুস্তিকা বলাই ভালো l সেই বই থেকে স্বামীজির কুমারীপূজা বিষয়ে কিছু আশ্চর্য কাহিনী জানা যায়।
তবে তার প্রতিটাই যে বেলুড় মঠে এমনটা নয়l
উত্তরপ্রদেশের (গাজীপুর) বিখ্যাত রায়বাহাদুর গগনচন্দ্র রায়ের (যিনি রবীন্দ্রনাথেরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন) শিশুকন্যা মনিকা রায়কে কুমারীরূপে পূজা করেন।
সেদিন যে অনাঘ্রাতা কুসুমের মধ্যে স্বামীজী দেবীত্বের জাগরণ ঘটিয়েছিলেন , পরবর্তীকালে সেই মণিকাদেবী হয়ে উঠেছিলেন যশস্বিনী সন্ন্যাসিনী।
১৮৯৮ সালের অক্টোবরে কাশ্মীরের এক প্রাচীন দেবীপীঠ ক্ষীরভবানীতে শাস্ত্ররীতির উর্ধ্বে গিয়ে তিনি কুমারীরূপে পূজা করেন মুসলমান -কন্যাকে। দেবীত্ব যে কেবল হিন্দু ব্রাহ্মণ কন্যাদের অন্তরেই লুকিয়ে থাকে না , প্রতিটি শিশু-কন্যার ভেতরেই তা সুপ্ত অবস্থায় থাকে তা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন l
১৮৯৯ সালে তিনি কন্যাকুমারী শহরে ডেপুটি একাউণ্ট্যাণ্ট জেনারেল মন্মথ ভট্টাচার্যের কন্যাকে কুমারীপূজা করেছিলেন।
১৯০১ সালে বেলুড় মঠের প্রথম দুর্গাপূজায় তিনি একসঙ্গে ৯ জন কন্যাকে কুমারীপূজা করেছিলেন।
এই নয়জন কুমারীর মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণের ভাইপো রামলালদাদার কনিষ্ঠা কন্যা রাধারানী যেমন ছিলেন,
তেমনি ছিলেন গৌরী মা’র পালিতা কন্যা দুর্গামা। যাঁর কপালে চন্দনের টিপ পরাতে গিয়ে স্বামীজি ভাবাবিষ্ট হয়ে আবেগভরে বলেছিলেন- “ আঃ! দেবীর বোধ হয় তৃতীয় নয়নে আঘাত লেগে গেল।”
স্বামীজির স্নেহধন্যা এই কন্যা পরবর্তীকালে সারদেশ্বরী আশ্রমে অধ্যক্ষারূপে প্রতিষ্ঠিতা হয়েছিলেন।
যে দেশে শিশু-কন্যাকে জগন্মাতা রূপে পূজা করার রীতি প্রচলিত, সেই দেশেই মেয়েদের নানা ভাবে নির্যাতিত হতে হচ্ছে , এটা ভাবতে অবাক লাগে l
দুর্গাপুজো বা নবরাত্রিতে যদি কোনো তিন বছরের শিশুকন্যাকে কন্যা বা কুমারী রূপে পূজা করা হয়, তবে তাকে ত্রিধা/ ত্রিধামূর্তি নামে সম্বোধন করাহয় l
কিছুদিন আগেই এক ছোট্ট ত্রিধা অকালে চলে গেল সারা শরীরে সুঁচ বেঁধানোর তীব্র যন্ত্রনা নিয়ে l
তবে এই সামাজিক অবক্ষয় রুখতে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই একটু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন l একটা ছোট উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার হবে হয়তো l
বাতাসে পুজোর গন্ধ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিছু মানুষ পুজোর প্রস্তুতিপর্বে প্রতিমা গড়ার মুহূর্ত গুলোকে ক্যামেরা-বন্দি করার মানসে ছোটেন কুমোরটুলি,
মৃন্ময়ী মায়ের নিরাবরণ মুর্তির ছবিতুলে ছড়িয়েদেন সোশ্যাল মিডিয়ায় l
যাকে “মা” বলে ডাকছি, সে মৃন্ময়ী হোক বা চিন্ময়ী , তার দেহে প্রাণ থাকুক বা না থাকুক, তার আব্রু রক্ষা করার দায়িত্ব তো আমাদেরই l রং বিহীন অসমাপ্ত দুর্গা মায়ের মূর্তিরও যে সুসজ্জিত অবস্থায় ছবি তোলা যায় তার উদাহরণ স্বরূপ একটা ছবি আপনাদের দেখাতে চাই, এই ছবিটা দেখেই এই লেখার ভাবনা , তাই লেখাটা যদি একটুও ভালোলেগে থাকে তবে কৃতিত্বটা আরও দুজনের প্রাপ্য l
কলকাতার দাঁ’বাড়ির এই অর্ধসমাপ্ত দুর্গাপ্রতিমার ফটো তুলেছে সোহম ( Wanderlust Soham ), আর এটা আমাকে দিয়েছে অভিজিৎ ( Abhijit Das ) l
🌿🍂🌿🍂🌿🍂🌿🍂🌿🍂🌿🍂🌿🍂🌿🍂🌿🍂