পান্তুয়ার বংশ
আজ একটা পরিবারের গল্প বলবো, সে পরিবারের গিন্নির নাম ক্ষীর আর কর্তা হলেন গিয়ে ছানা৷
ষষ্টী-ঠাকরুনের আশীর্বাদে সাত সন্তান নিয়ে তার ভরা সংসার; পান্ত্তয়া, লেডিকেনি, কালোজাম, গুলাবজামুন, লালমোহন, ল্যাংচা আর নিকুতি৷
পরিবারের প্রথম সন্তান ‘পান্তুয়া’র জন্ম লগ্ন নিয়ে সঠিক কোনো ধারণা পাওয়া যায়না, তবে উনি জন্মেছেন এই বঙ্গে। ‘পান্তুয়া’র প্রস্তুত কারক হিসাবে যার নাম সর্বাগ্রে আসে তিনি রানাঘাটের জগু ময়রা বা যজ্ঞেশ্বর প্রামাণিক। তারা বংশ পরম্পরায় এখনও পান্তুয়া প্রস্তুত করে চলেছেন। জগু ময়রার নামে সেই দোকান আজও আছে।
‘লেডিকেনি’র জন্ম হয় কলকাতায়, বৌ বাজারের
স্বনামধন্য মিষ্টির দোকান ভীম চন্দ্র নাগ এর আঁতুড়-ঘরে, সালটা বোধহয় ১৮৫৬ ; ব্রিটিশ ভারতের প্রথম ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং-এর স্ত্রী (Charlotte Canning) লেডি ক্যানিং-এর জন্মদিনের স্মারক হিসেবে।
‘কালোজাম’ সম্পর্কে বিশেষ কিছু ধারণা দিতে পারবো না; শুধু জানি এতে খোয়া ক্ষীরের পরিমান বেশি থাকে, আর থাকে চিনি, তাই ভাজলে কালো হয়ে যায়। গায়ের রং কালো বলে বাপ-মা আদর করে নাম রেখেছিল ‘কালোজাম’।
চতুর্থ সন্তান ‘গোলাপজামের’ বিয়ে হয়েছিল এক অবাঙালি পরিবারে ; তাই সে আজ নাম বদলে হয়েছে ‘গুলাবজামুন’। এর পেটের ভিতরটা ফাঁপা নয়, নিরেট।
‘ল্যাংচা’র জন্ম কালনায়, জন্মবৃত্তান্তটি নিয়ে এক মজার কাহিনী প্রচলিত আছে। ইতিহাস বলে কৃষ্ণনগরের রাজপরিবারের এক মেয়ের বিয়ে হয় বর্ধমান রাজ-পরিবারে। নতুন বৌ মিষ্টি মুখে দেয়না, সীতাভোগ এর দিকে মুখ ভেটকে তাকায়; বার কাকুতি মিনতি করে জানা যায়, তার বাপেরবাড়িতে এক ময়রা রোজ মিষ্টি নিয়ে আসতো, অনেকটা পান্তুয়ার মতো দেখতে কিন্তু একটু লম্বাটে, অপূর্ব তার স্বাদ। রাজার মেয়ে বলে নাম জানার দরকার পড়েনি, সে কোথায় থাকে তা জানেনা, তবে লুকিয়ে সেই দেবভোগ্য মিষ্টির কারিগরকে সে দেখেছে। লোকটি খুঁড়িয়ে হাঁটে তাই মিষ্টিটার কথায় তার মাথায় আসে ‘ল্যাংচা’ শব্দটা। খোঁজ খোঁজ.. অবশেষে কালনায় পাওয়াগেলো সেই ময়রাকে। রাজারাজরার ব্যাপার, ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে; কারিগরের পুরো গুষ্টিকে নাদিয়া থেকে বর্ধমান উঠিয়ে নিয়ে আসা হলো, এরাই বর্ধমানের বিখ্যাত ল্যাংচার জাদুকর, যে জাদু আজ ও অব্যাহত।
‘পান্তুয়া’ আর ‘লেডিকেনি’র সঙ্গে ‘লালমোহন’ এর চেহারার এতো মিল যে বাইরে থেকে দেখে তফাৎ বোঝা খুব মুশকিল; লালমোহন বাবুর পরিবারের একটা শাখা এখন থাকেন বাংলাদেশে, আর অন্য শাখাটি থাকেন নেপালে। খুব সঙ্গত কারণেই ওদের মধ্যে কিছু প্রাদেশিকতার ছোঁয়া দেখা যায়, যেমন , নিরামিষ লালমোহন এখন ডিম্ এর সঙ্গে গাটছড়া বেঁধেছেন।
কনিষ্ঠটি অর্থাৎ ‘নিকুতির’ আজ কাল বড়ো একটা দেখা পাওয়া যায়না, মাঝে মাঝে সীতা-ভোগের মধ্যে দুএকটা নজরে পরে। পান্তুয়ার ক্ষুদ্র সংস্করণ এই নিকুতি শুনছি নাকি কালনার দিকে বাড়ি করে উঠে গেছে।
কোনো কুলিন মিষ্টান্নের বংশ-তালিকা তৈরী করতে যে এতো কাঠখড় পোড়াতে হয়, তা আজ হাড়েহাড়ে টের পেলুম। যাক সেসব কথা, অনেকে বলেন লেডিকেনিতে ছানার ভাগ বেশি থাকে৷ পান্ত্তয়াতে থাকে বেশি খোয়াক্ষীর৷
এতক্ষনে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন যে, আজ যাকে বানাতে চলেছিই সে এই সাত কৃতি-সন্তানের মধ্যে কোনো একজন৷
এবার চলুন দেখে নেওয়া যাক কী কী লাগবে –
〰〰〰〰〰〰〰〰〰〰〰〰〰〰〰
✔ছানা-২ কাপ (জল ঝরানো)
✔ময়দা-১/২ কাপ
✔সুজি – ২ টেবিলচামচ (১ ঘন্টা জলে ভেজানো)
✔খোয়া ক্ষীর-১,১/২ কাপ
✔বড়ো এলাচের দানা – ১ টেবিলচামচ
✔গাওয়া ঘি – ৩ টেবিল চামচ
✔নকুলদানা বা এলাচদানা – কয়েকটা
✔সাদা তেল – ভাজার জন্য
রসের জন্য-
〰〰〰〰
✔জল-৪ কাপ
✔চিনি – ২ কাপ
✔ছোট এলাচ গুঁড়ো – ১ চাচামচ
কীভাবে বানাবেন –
〰〰〰〰〰〰
🔴জল, চিনি ও ছোট এলাচ গুঁড়ো একসঙ্গে ফুটিয়ে সিরা/রস বানিয়ে রাখুন।
🔴ছানা ও খোয়া ক্ষীর হাতের চাপে একদম মিহি করে নিন।
🔴একটা বাটিতে ঘি, ময়দা, সুজি, এলাচ গুঁড়ো একসঙ্গে মিশিয়ে নিন। এবার এই মিশ্রণ ছানা ও ক্ষীরের সঙ্গে মিশিয়ে ভাল করে মেখে হাতের চাপে গোল গোল বল বানিয়ে নিন।
🔴এবার প্রতিটি বলের পেটের মধ্যে পুরে দিন একটা করে বড়োসড়ো নকুলদানা, যাতে ডুবো তেলে ভাজার সময় গরমে ওই নকুলদানা টি গলে গিয়ে পেটের ভিতরটা ফাঁপা হয়।
🔴এই বল ডুবোতেলে মিডিয়াম আঁচে ভেজে গরম রসে ফেলুন। ভাল করে রস ঢুকে ঠান্ডা হলে পরিবেশন করুন।
🔴এবার খেয়ে বলুন তো আজ যাকে বানালাম তার নাম কি ? 😊