গল্প

ডাইনীর গল্প

কলমে মৌমিতা ( Prianxi )

মাদুরটা বগলদাবা করে ধুপধাপ শব্দ তুলে ছাদের সিঁড়ি দিয়ে উঠছে বিস্কুট , সেজোকাকার ছেলে | পোষাকি নাম অমোঘ চৌধুরী , পুণেতে একটা MNC তে চাকরি করে | পুজোয় দেশের বাড়ি এসেছে, এখন এক্সটেন্ডেড ছুটি মানে ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে.। কোভিদের পর থেকে এই নোতুন রোগে আক্রান্ত IT ইন্ডাস্ট্রি | তার পেছন পেছন চলেছে চিনি – মেজকার মেয়ে , ভালো নাম চিরশ্রী , এখানেই একটা সরকারী স্কুলে পড়ায় | 

মাদুরের রোলটা ছাদের কার্নিশে হেলান দিয়ে দাঁড়করিয়ে ছাদ থেকে ঝুঁকে চণ্ডীমণ্ডপের আটচালাটার দিকে তাকায় বিস্কুট | অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিয়ে ছোটদাদুকে খুঁজতে থাকে | মফঃস্বলে কার্তিকের বিকেল গুলো বড্ডো ছোট , ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে আসে।  ছোটদাদুদের বাড়িটা চণ্ডীমণ্ডপ থেকে প্রায়  ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বে। দাদু এসময়টা তার পাড়াতুতো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সেখানেই বসে গল্পগুজব করে । পাড়ার দুর্গা পুজো হোক কি কালীপুজো , সব প্রতিমা এই চণ্ডীমণ্ডপের আটচালাতেই তৈরী হয় । আজ সকালে মাকালির মুণ্ডমালার মুন্ডু গুলো বানিয়ে রোদে শুকনো করতে দিয়েছিলো নিকুঞ্জদা। কালীঠাকুরের দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাক্ষুসী দুটোকে তখন সদ্য রঙ করে বটতলায় শুকোতে দেওয়া হয়েছিল । দুদিন পর ভূত-চতুর্দশী। এবছর পাড়ার কালীপুজোয় ছিন্নমস্তার বিগ্রহ তৈরী হচ্ছে | মা কালীর রূপ হলে কি হবে এই ছিন্নমস্তার রং নাকি কালো নয় , লাল | দুটো কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে ঠাকুরের গায়ে রঙ করার কাজ চলছে দ্রুত গতিতে | সেদিকে তাকিয়ে চিনির মনে পড়ে গেলো কলেজ থেকে বাঁকুড়ায় এক্সকারসনে গিয়ে প্রথম দেবী ছিন্নমস্তার মন্দির দেখেছিল| ওই আলো-আঁধারিতে দূরে বটতলায় দাঁড়করানো রাক্ষুসী গুলোর দিকে চোখ পড়লো হঠাৎ | এই লোডশেডিংয়ে কুপির কম্পমান হাল্কা আলোয় তৈরী ডাকিনী যোগিনী দুটোর লম্বা ছায়া .. শিরশিরে উত্তুরে বাতাস  … সব মিলিয়ে একটা বেশ গা ছমছমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যা ভূতের গল্প শোনার জন্য একেবারে আদর্শ । 

সামনে কালী পুজো বলে কিনা জানি না রোজ সন্ধ্যে বেলা এই সময়টা এক দেড় ঘন্টার জন্য পাওয়ারকাট হয় এখানে। আর ঠিক সেই সময়টায় ছাদে খোলা আকাশের নিচে বসে তাদের ‘গল্প দাদুর আসর’ , ছোটদাদু তাদের বিভিন্ন গল্প বলে , কখনো পৌরাণিক গল্প , কখনো ভূতের আবার কখনোবা  তাঁর দীর্ঘ চাকরি-জীবনের বর্ণময় গল্প। আগে যখন ওরা  আরও ছোট ছিল সেসব দিনে কখনো লোডশেডিং হলে এভাবে ছাদে উঠতো সবাই , সঙ্গে মা ফুলপিসি । বাড়ির পাশেই থাকতো মিতুল পিসিরা | ফুলপিসির সঙ্গে পিঠোপিঠি , খুব ভাব দুজনে।  লোডশেডিংয়ে ছাদে উঠলেই আম পাড়ার আঁকশির মুখে পলিথিনের প্যাকেট ঝুলিয়ে তার ভেতরে স্টিলের বাটি  নয়তো রেকাবি বসিয়ে এক অভিনব কায়দায় মালপোয়া , তালের বড়া, তালের পিঠে চালাচালি হতো। ওতে এক আলাদাই আনন্দ | ছাদের সিঁড়িতে ওঠার সময় দেখে এসেছি মা আর ফুলপিসি রান্না ঘরে ছোটদিদাকে হাতেহাতে সাহায্য করছে। আলোটা আসলেই দোতলা থেকে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাক পড়বে। দোতালার টানা বারান্দার লাল মেঝের ওপর সারি দিয়ে আসন পাতা হবে , বাগানের টাটকা কলাপাতায় ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত আলুভাতে আর গাওয়া ঘি ,, তারপর ডাল ঝুরি-আলুভাজা , সবজি মাছ মাংস ডিম্ যেদিন যেমন হয় আরকি। কোনো কোনো দিন দিদুনের নিষেধ অগ্রাহ্য করে ছোটকা সন্ধ্যের দিকে পুকুরে ছিপ ফেললে বা ঘনি মগরি বসালে ঘি ভাতের সঙ্গে টাটকা মাছ ভাজাও মেলে। নাতি নাতনীদের পাতে গরম মাছভাজা দিতে দিতে গজগজ করে দিদুন – “ যত অলুক্ষুণে কাণ্ড তোর কাকার , এই রাত-বিরেতে মাছ ধরলে তেনাদের নজর পড়ে .. বললে কথা শোনেনা ছেলেটা …” | এসব আনন্দ শহুরে জীবনে পাওয়া যায় না বলেই ছুটি গুলোতে তারা যে যেখানেই থাকুক এখানে আসার জন্য মুখিয়ে থাকে। ফুলপিসি আর পিসেমশাই সবে কাল ফিরেছে হিমাচল থেকে । দুদিন থেকে,  ভাইফোঁটা কাটিয়ে বাড়ি ফিরবে | ছোট পিসেমশাই গিরিডিতে স্টেশন-মাস্টার | পিসিরা ওখানেই রেলের কোয়ার্টারে থাকে | ছবির মতো সুন্দর বাংলো প্যাটার্নের কোয়াটার । 

মাদুরটা বিছিয়ে ছাদের কার্নিশ থেকে মুখ বাড়িয়ে হাঁক পাড়ে বিস্কুট – “ দাদু.. তোমার আর কত দেরি ? ‘“। ছাদের উত্তর-পূর্ব কোণে দাঁড়করানো একটা লম্বা সরু বাঁশের মাথায় জিরো পাওয়ারের বাল্ব আটকানো – আকাশ-প্রদীপ। বংশের পূর্বপুরুষরা যাঁরা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন তাদের আলো দেখানোর উদ্দেশ্যে। আমার বেশ মনে আছে একবারেরকথা  …সেসময় এরকম ইলেক্ট্রিকের বাল্ব নয় মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে রোজ ছাদের কোণে রেখে দিয়ে যেত দিদুন |  চিনি তখন বেশ ছোট , ৫ কি ৬ হবে | দিদুনকে জিজ্ঞাসা করেছিল – “ আচ্ছা দিদুন , শুধু এই মাসেই কেন ওদের আলো দেখতে হয় ? এমাসে কি ওখানে লোডশেডিং হয় ?  “ চিনি তো নয় যেন আস্ত তিলে-পাটালি ! কি সব উদ্ভট প্রশ্ন আসতো ওর মাথায় , ব্যাপারে।  তখন কি আর জানতুম ইউরোপ আমেরিকাতেও এই সময়ে ভূত-চতুর্দশীর মতোই হ্যালোউইন উৎসব পালন করা হয়। | 

সিঁড়িতে দাদুনের  পায়ের শব্দ শুনে সবাই মাদুরে গিয়ে চুপটি করে বসলো | দাদু আসতেই চিনি বলে উঠলো – “ দাদান , আজ কালী পুজো নিয়ে কোনো গল্প বলবে প্লিজ “|  বিস্কুট আর আমি প্রতিবাদী ভঙ্গিতে বলে উঠলাম – না , না … ভূতের গল্প হবে আজ, কাল ভূত-চতুর্দশী , তাই আজ “তেনাদের “ অনারে ভূতের গল্প “ | 

দাদু , বরাভয় ভঙ্গিতে সবাইকে শান্ত করতে করতে বললেন – “ আচ্ছা , আজ এমন একটা গল্প বলবো যাতে কালী ঠাকুরও আছে , আবার তোমাদের ওই যে তোমাদের ওই হ্যারি পটারের গল্পের ঝাঁটায় চড়ে উড়ে বেড়ানো witch ওই রকম উড়ুক্কু ডাইনীও আছে | 

“ভূতের গল্পের সঙ্গে গরম চা আর মুড়িমাখা হলে কেমন হয় ? “ – পিসিমণির গলা শুনে ছাদের সিঁড়ির দিকে ফিরে তাকাই আমরা | একটা কাঠের ট্রেতে ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা আর এক জামবাটি আচারের তেলদিয়ে মাখা মুড়ি সঙ্গে সিঙ্গাড়া নিয়ে হাজির ফুলপিসি | ট্রের থেকে একটা কাপ তুলে নিয়ে আদা দেওয়া চেয়ে চুমুক দিয়ে দাদু বলে ওঠেন – “ হ্যাঁ রে খুকি , তোরা এবারে হিমাচলে গিয়ে রেওয়ালসর লেক দেখতে গেছিলি ?“ 

ছেলে মেয়ে যতই বড় হোক বাবা মায়ের কাছে তারা খোকা খুকুই থেকে যায় |  পিসিমণি , আমাদের হাতে হাতে সিঙ্গাড়া গুলো দিতে দিতে বললো – “ হ্যাঁ বাবা দেখেছি ,ওখানে একটা মনেস্ট্রিও ছিল , আর একজন বুদ্ধিস্ট মঙ্কের বিশাল বড় মূর্তিও ছিল …. কি যেন নাম !!!. হ্যাঁ পদ্মসম্ভব “ | 

“ঠিক,  গুরু পদ্মসম্ভব বা রিনপোচে “ দাদু বলতে শুরু করলেন. …. আজকের গল্পের শুরু অষ্টম শতাব্দীতে , যে সময়ে নালন্দা বৌদ্ধবিহার ছিল ভারতের বিদ্যা-শিক্ষা চর্চার অন্যতম পীঠস্থান | সেই সময় তিব্বতের রাজা ছিলেন খ্রি-স্রোং-ল্দে-ব্ত্সান | বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তাঁর ছিল প্রবল আগ্রহ | তাঁর ইচ্ছে হল নালন্দা বৌদ্ধবিহার থেকে বাছাই করা কিছু ভারতীয় মহাজ্ঞানী বৌদ্ধ ভিক্ষুকে তিব্বতে আমন্ত্রণ করে আনবেন তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার ও তার প্রসারের উদ্দেশ্যে | এই কাজে যথাক্রমে আচার্য্য শান্তরক্ষিত, পরে গুরু রিনপোচে বা পদ্মসম্ভব ও বিমলমিত্র তিব্বত গমন করেন এবং  সেখানে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রাজা খ্রি-স্রোং-ল্দে-ব্ত্সান তাঁর পাঁচ রাণীর মধ্যে একজনকে গুরু রেনপোচের কাছে নিবেদন করেছিলেন তাঁর সাধনসঙ্গিনী হিসেবে সাধনায় সাহায্য ও সাধন পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করার জন্য । 

যাক , যেটা বলছিলাম – তখনকার দিনে তো এমন উন্নত যানবাহন  ছিল না , তার ওপর আবার বৌদ্ধ ভিক্ষু , তাই পরিব্রাজক রিনপোচে পায়ে হেঁটেই নালন্দা বৌদ্ধবিহার থেকে হিমাচল ও নেপাল ঘুরে তিব্বতে যাবেন – এমনটা মনস্থির করলেন | তাঁর এই দীর্ঘ যাত্রা পথে মাঝে মাঝে তিনি থামেন মাধুকরী ও ধর্মপ্রচার করেন, আবার চলেন | এমন ভাবে চলতে চলতে তিনি এসে পৌঁছলেন হিমাচল প্রদেশের মান্ডিতে | সেখানে নয়না দেবীর মন্দিরের পাশে এক দুর্গম গুহার সন্ধান পেয়ে সেখানে কিছুদিন নিভৃতে অবস্থান করবেন বলে মনস্থির করেন | নির্জনে সাধনাও হবে আবার মাধুকরীর জন্য লোকালয়ে গেলে ধর্ম প্রচারও হবে | এই নয়না দেবীর মন্দিরের সঙ্গে আবার নৈনিতালের নয়নাদেবীর মন্দিরকে গুলিয়ে ফেলোনা যেন তোমরা | নৈনিতালের নয়নাদেবীর মন্দির একান্নটি  সতীপীঠের অন্যতম শক্তিপীঠ | আর এই রেওয়ালসরের নয়না মাতা মন্দির সম্পূর্ণ আলাদা | এই মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে আবার অনেকে তারাদেবী বা তারিণী মাতাও বলেন |  কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ রচিত বৃহদতন্ত্রসার গ্রন্থের কথা তো তোমরা জানোই | সেই বইতে তারা দেবীর যে দশাক্ষর মন্ত্র আছে , তা হল  – 

🌺 ” ওঁ তারে তারে তুত্তারে স্বাহা ” 🌺

আবার দশমহাবিদ্যায় বর্ণিত এই তারামায়ের মন্ত্রের সঙ্গে বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের তিব্বতি শাখা উল্লেখিত প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের দেবী তারার ধ্যান অনুশীলন মন্ত্র প্রায় একই | 

🌺 ” ওঁ তারে তুত্তারে তুরে স্বাহা ” 🌺

বিভিন্ন আন্তরিক গুণাবলি যেমন প্রজ্ঞা , দয়া প্রভৃতির বিকাশের জন্য , সর্বোপরি বোধি লাভের জন্য এই দেবী হরিৎ তারার আরাধনা করেন বজ্রযানি বৌদ্ধেরা । যিনি কিনা আবার অবলোকিতেশ্বরের চোখের জল থেকে সৃষ্ট | তন্ত্রসারে তারার আরও একটি ধ্যানমন্ত্র বর্ণিত হয়েছে: “শ্যামবর্ণা ত্রিনয়ণা চতুর্ভূজা, বরমুদ্রা ও পদ্মধারিকা, চতুর্দিকে বহুবর্ণা ও বহুরূপা শক্তির দ্বারা বেষ্টিতা, হাস্যমুখী মুক্তাভূষিতা, রত্নপাদুকায় পাদদ্বয় স্থাপিকা তারাকে ধ্যান করবে।” সেই মূর্তির বর্ণনার সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মে উল্লেখিত তারা দেবীর সাদৃশ্য চোক পড়ার মতো।

মজার ব্যাপার হল অবলোকিতেশ্বরের সঙ্গে আমাদের ঘরের ছেলে ভোলা মহেশ্বর বা শিবঠাকুরের অনেক মিল আছে | তোমরা যদি সারনাথে যাও , দেখবে সেখানকার মিউজিয়ামে বোধিসত্ত্ব নীলকন্ঠ অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি আছে ( 5th -6th  cent. A.D. ) , নীলকন্ঠ শিবের মতোই | 

যাইহোক , আবার মূল গল্পে আসি – 

তারাদেবীর মন্দিরের কাছে সেই গুপ্ত গুহায় নির্জনে বাস করলে কি হবে নগর পরিক্রমা কালে ওড়িষার রাজবংশজাত এই সুপুরুষ যুবা সন্ন্যাসী মান্ডির রাজকুমারী মন্দর্ভার নজরে পড়েন | আসলে এসবই পূর্ব-নির্ধারিত ভবিতব্য | এদিকে মন্দর্ভার বাবা মাণ্ডির রাজা আরসাধর ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তখন অবশ্য ওই জায়গার নাম ছিল জাহর ( zaahor )| বৌদ্ধধর্ম প্রসারে রাজার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না | হলে কি হয় , রাজার মেয়ে মন্দর্ভা ততক্ষণে মহাজ্ঞানী রিনপোচের গুণে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে মন প্রাণ সোঁপে তাঁর কাছে বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করছেন | মন্দর্ভার পূর্বজন্মের সিদ্ধি এবং জ্ঞান গরিমা পর্যবেক্ষণ করে রিনপোচে বুঝছিলেন উনি তাঁর সাধন-সঙ্গী হওয়ার উপযুক্ত আধার | রাওয়ালসারের নয়নাদেবীর ( তারাদেবীর ) মন্দিরে পাশের ওই দুর্গম গুহায় তিনি মন্দর্ভাকে বজ্রযানী গুপ্ত তন্ত্রের দীক্ষা ও শিক্ষা দিতে লাগলেন | প্রচলিত লোককথা অনুযায়ী এমনি এক গুপ্ত তন্ত্র-সাধনা চলাকানীল এক মেষপালক তাঁদের দুজনকে আপত্তিজনক অবস্থায় দেখে ফেলেন | প্রথমে সে রাজাকে বলতে ভয় পেলেও এসব খবর তো আর চাপা থাকার নয় | তার ওপর রাজপরিবারের “কেচ্ছা” বলে কথা,  লোকমুখে বেড়ে চড়ে ঠিক পৌছালো গিয়ে রাজার কানে | রাগে অগ্নিশর্মা রাজা নিজের মেয়ের মৃত্যুদন্ডাদেশ দিলেন | তাঁর আদেশ রাজকুমারীকে এক বিশাল কুঁয়োর মধ্যে নিক্ষেপ করা হল জীবন্ত অবস্থায় | 

আর ওনার প্রাইভেট টিউটর মানে পদ্মসম্ভবের কি হলো দাদান ? “ –  চিনি থমথমে মুখে জানতে চায় | “ তাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার জন্য ধরে নিয়ে আসতে লোক পাঠানো হলো “ – দাদু বললে | “ আরে .. এতো পুরো অনার কিলিং এর ঘটনা !! “ আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো কথাটা স্বগতোক্তির মতো | 

এমন সময় পাড়ায় চারিদিকে আলো জ্বলে উঠলো | মানে কারেন্ট এসে গেছে , তারমানে এক্ষুণি দোতালা থেকে হাঁকডাক শুরু হবে ছাদ থেকে নামার জন্য | যেমনি ভাবা তেমনি ডাক …. বম্মা ( বড় জ্যাঠিমা ) হাঁক পারলো – “ খাওয়ার জায়গা করা হয়েছে , চলে আয় দিকি সব দেরি করিসনি “ | ততক্ষণে , দিদুন সশরীরে অকুস্থলে পৌঁছে গেছেন , ছাদে উঠেই দাদুর ওপর ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ( কপট ঝাঁঝ যদিও ) – “ বলি , বুড়ো বয়েসে বুদ্ধি কি সব শিকেয় তুলে রেকেচো নাকি ? কাত্তিকের হিমে বাচ্চা গুলোর ঠান্ডা লেগে জ্বর হলে তখন তো ওদেরই ভুগতে হবে নাকি ? খেতে চল সব “ পিসিমণি তাড়াতাড়ি বলে উঠলো – দাঁড়াও মা দাঁড়াও ….. এখন খুব ক্রিটিকাল সিচুয়েশন , রাজকুমারীকে কুঁয়োর ফেলে মারার চেষ্টা হচ্ছে | তুমি যাও , আমরা আসছি | দিদান ততক্ষণে গজগজ করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করে দিয়েছে | 

দাদু বলে চললেন  – “ আসলে অনার কিলিং সে সময়ও ছিল , বরং বেশি ছিল | রাজার মেয়ের সঙ্গে রাখাল ছেলের প্রেমের উপাখ্যান রূপকথার রাজ্যে আখচার শোনা যায় , তাই নয় কি ? কিন্তু সব ক্ষেত্রে তো আর happy এন্ডিং হয় না | অনেক সময়েই তাদের মেরে ফেলা হতো | কেউ সে নিয়ে টু শব্দটিও করার সাহস পেতো না | চিনি কিন্তু বেজায় সিরিয়াস , গম্ভীর মুখে বলে উঠলো – “ lets come to the point দাদান | পদ্মসম্ভবের কি হল সেটা বলো আগে | “ আরে তখনই তো পদ্মসম্ভব “পদ্মসম্ভব”  হলো – দাদু বলে উঠলেন | এবার তাদের বিস্মিত হবার পালা | সবাই মিলে একসাথে  বলে উঠলো – “ মানে !!!!! “ 

দাদান আবার বলতে শুরু করলেন – এখন যেখানে রেওয়ালসর লেক তখন সেখানে ছিল এক বিশাল ফাঁকা প্রান্তব , ওই পাহাড়ি অঞ্চলের ম্যালের মতো আরকি | সেখানে শুকনো কাঠ খড়কুটো আর যাবতীয় জ্বালানি জড়ো করে তার মধ্যে পদ্মসম্ভবকে বসিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হলো | ওই যেমন দোলপূর্ণিমার আগেরদিন হোলিকা দহন বা ন্যাড়া পোড়ানো হয় – ওই রকম করে | টানা তিনদিন জ্বলার পর সে আগুন নিভলো এবং সবাই অবাক হয়ে দেখলো ওই যে বিশাল প্রান্তরের মাঝে তাঁকে জ্বালানোর আয়োজন করা হয়েছিল সেখানে তৈরী হয়েছে এক বিশাল সরোবর আর তারটলটলে জলের মাঝে প্রজ্বলিত অগ্নিকুন্ডের বদলে ফুটে রয়েছে এক বিশাল পদ্মফুল | সেই প্রস্ফুটিত পদ্মের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন বালক রিনপোচে – এ যেন তার নবজন্ম | সেদিন থেকেই পদ্মসম্ভূত রিনপোচে হলেন “পদ্মসম্ভব” অর্থাৎ পদ্মজাত | সিদ্ধিপ্রাপ্ত রাজকন্যাকেও জীবিত অবস্থায় কূপ থেকে উদ্ধার করা হয় | রাজা ততক্ষণে বুঝে গেছেন এই সাধক কোনো সাধারণ ভিক্ষু নন , কোনো সিদ্ধিযোগী | তিনি তাঁর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা তো চাইলেনই তার সঙ্গে নিজের মেয়েকেও তাঁর হাতে সমর্পণ করলেন এবং পদ্মসম্ভবের কাছে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেন | লোকমুখে শোনা যায় এরপর পদ্মসম্ভব তাঁর সাধন-সঙ্গিনী রাজকুমারী মন্দর্ভাকে নিয়ে নেপালের পথে পাড়ি দেন | | হিমাচলের মান্ডিতে এই গুহা আজও বজ্রযানী বৌদ্ধদের কাছে পবিত্র সাধনাস্থল | সম্প্রতি এই গুহার সংস্কারের কাজ চলছে যাতে দর্শনার্থীদের কাছে তা সুগম হয়ে ওঠে | তিব্বতী বজ্রযানী বৌদ্ধরা এই রাজকুমারী মন্দর্ভাকে প্রজ্ঞা ও দীর্ঘায়ু প্রদায়িনী মান্দারভা ডাকিনী বলে মানেন , যাঁর মন্ত্র হলো –

“ ওঁ হ্রিং বাম যানা ডাকিনী মান্দারভা আয়ু সিদ্ধি যা হুং “ 

বৌদ্ধ তন্ত্রসাধকরা মনে করেন – একাদশ শতকে এক সম্ভ্রান্ত বংশীয় কাশ্মীরি ব্রাহ্মণের ঘরে এক কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে যিনি পরবর্তীকালে বৌদ্ধ তন্ত্র গুরু না-রোপার সাধনসঙ্গিনী ডাকিনী নিগুমা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন | তারা এও মনে করেন এই নিগুমা ডাকিনী আগের জন্মে. রাজকুমারী মন্দর্ভা ছিলেন | এ ডাকিনী কিন্তু আমাদের গ্রাম গঞ্জে প্রচলিত ডাইনির মতো নয় | তিব্বতী তন্ত্রে সংস্কৃত থেকে আগত এই “ডাকিনী” শব্দটা বেশ শ্রদ্ধা এবং সম্ভ্রমের সঙ্গে প্রয়োগ করা হয় | 

ডাইনী বলতেই যে ছবি আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে এই তিব্বতী খান্ড্রো বা ডাকিনীরা কিন্তু তাদের থেকে অনেকটাই আলাদা | আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ডাকিনী বলতে বুঝি যে সমস্ত স্ত্রীলোক নিম্ন শ্রেণীর তন্ত্রচর্চা বা অভিচার ক্রিয়া করে যেমন মারণ উচাটন প্রভৃতি , অর্থাৎ সোজা কোথায় লোকের ক্ষতি করে , যারা ভূর্জ বৃক্ষের গুঁড়িতে চড়ে আকাশ পথে উড়ে উড়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারে , লোক জনকে ডাক দিয়ে ভুলিয়ে নিয়ে যায়, তাদের রক্ত মাংস খায় … এই সবই তো ? 

আবার ইউরোপ , আমেরিকায় ডাইনি বা witch বলতে মনে যে ছবি ভেসে ওঠে তা হল কালো পোশাক পরা এক লোলচর্ম বৃদ্ধার চেহারা , যার মাথায় ছুঁচালো একধরণে কালো টুপি অনেকটা জোকারের টুপির মতো, যে ম্যাদুবিদ্যা জানে , আবার লম্বা ঝাঁটার ওপরে চড়ে আকাশের উড়ে বেড়ায় | …

তিব্বতী বজ্রযানী বৌদ্ধতন্ত্রে কিন্তু উচ্চমার্গের সিদ্ধসাধিকাদের অনেক সময় ডাকিনী বলা হয় | এদেরও সিদ্ধি প্রদান করার ক্ষমতা থাকে বলে ওরা মনে করেন | বৌদ্ধ বজ্রযান তন্ত্রে এক আরাধ্য দেবী হলেন বজ্রবারাহী , এই দেবীর নাম সর্ববুদ্ধা ডাকিণী এবং এঁর দুই সহচরীর নাম বজ্রবৈরোচনী ও বজ্রবর্ণিনী। একত্রে তাঁরা ত্রি-কায়া বজ্রযোগীনি নামে পূজিতা হন | 

বজ্রযোগীনি মন্ত্র – 

🌺 ওঁ ওঁ ওঁ সর্ববুদ্ধা ডাকিনী , বজ্রবর্ণনী , বজ্রবৈরোচনী হুঁ হুঁ হুঁ ফট্ ফট্ ফট্ স্বাহা 🌺 

এই যে এবছর পাড়ার কালীপুজোয় দেবী ছিন্নমস্তার বিগ্রহ তৈরী হচ্ছে তার দুপাশে যে দুজন ” রাক্ষসী ” দাঁড়িয়ে থাকে তাদের একজনের নাম ডাকিনী অপর জনের নাম বর্ণিনী | “ছিন্নমস্তাকল্প” গ্রন্থে তাকেই  “সর্ববুদ্ধি” নামে অভিহিত করা হয়েছে , তার সহচরীদের বৌদ্ধ নামগুলি অবশ্য এক্ষেত্রে একই | আবার বজ্রবারাহীর সঙ্গে মা দুর্গার অংশজাত চৌষট্টি যোগিনীদের মধ্যে অন্যতম দেবী বরাহীর নামের মিল পাওয়া যায় | বজ্রবারাহীকে দেবীকে বজ্রযোগিনীও বলা হয় অথচ তাঁর মন্ত্রে তাঁকে “সর্ববুদ্ধা ডাকিনী” বলে আবাহন করা হচ্ছে সেটা তো আগেই বলেছি | দুর্গাপূজার দশমীর দিন এবং জগৎধাত্রী পূজার দশমীতে দেবী অপরাজিতার পূজা করা হয়। সারনাথের মিউজিয়ামে রক্ষিত দেবী অপরাজিতার মূর্তির সঙ্গে আবার এই বজ্রডাকিনীর বিগ্রহের অনেক মিল আছে।

আবার দেখো , আমাদের দেশের উড়িষ্যার  হীরাপুর , মধ্যপ্রদেশের মোরেনা প্রভৃতি অঞ্চলে চৌষট্টি যোগিনীর যে প্রাচীন মন্দিরগুলি আছে সেসব মন্দিরে ছাদ নেই। এই সব দেবালয়ে মধ্যস্থলে থাকেন শিবশক্তি যুগল, তাঁদের ঘিরে চক্রাকারে অবস্থান করেন যোগিনীবৃন্দ। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, নিশুতি রাতে মন্দির যখন একেবারে নির্জন থাকে , তখন এই যোগিনীরা বায়ুপথে পাড়ি দেন আকাশমণ্ডলে, আবার ভোর হবার আগেই ফিরে আসেন। তাঁদের উড্ডয়নের পথ অবাধ রাখতেই এই মন্দিরগুলি হয় ছাদবিহীন | বৌদ্ধ বজ্রযানী তন্ত্রে বর্ণিত খান্ড্রো বা ডাকিনীদেরও এই রকম আকাশে বিচরণের ক্ষমতা আছে বলে মনে করা হয় | ডাকিনী সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে পারলে সাধক অনেক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয় ঠিকই কিন্তু কারোর ক্ষতি করার মনোস্কামনা নিয়ে ডাকিনী সাধনা করতে বসলে তার শেষ পরিণতি হয় খুব করুণ , সেক্ষেত্রে ক্ষতি হয় সেই সাধকেরই | ভুললে চলবে না তাঁরাও মহামায়ার অংশ , দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্যই যাঁর প্রকাশ | শিষ্টের পালন তো উনারা সব রূপেই করতে পারেন , কিন্তু ভয়াল ভয়ঙ্কর বা ভীষণ উগ্র মূর্তিতে প্রকট হওয়ার প্রয়োজন একমাত্র তখনই পড়ে যখন উনারা দুষ্টের দমন করতে চান | আর সেই প্রচণ্ডার সাধনা করবে অন্যের ক্ষতি চেয়ে !! তা কি করে মা মেনে নেবেন ?

সব ক্ষেত্রেই এই নারী বা নারীশক্তিরা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারিণী, নভোচারিনী | কোথায় গিয়ে যেন বিদেশী “ urban legend “ এর সঙ্গে আমাদের দেশের প্রচলিত লোকগাথা , দেব-দেবীর উপাখ্যান আর বৌদ্ধ মাইথোলজি সব মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে | 

উচ্চকোটির সাধক সাধিকাদের মধ্যে অনেকেই ডাকিনী সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন | এদের মধ্যে এই মুহুর্তে যাঁর কথা সবার আগে মাথায় আসছে , তিনি হলেন তিব্বতী সিদ্ধ সাধক মিলারেপা | সবাই জানে আজও পর্যন্ত কেউ শিবভূমি কৈলাসের শিখরে চড়তে পারেননি | কিন্তু তিব্বতীরা মানেন একমাত্র মিলারেপাই এই অসাধ্য সাধন করতে পেরেছিলেন |

মিলারেপার গল্প আরেকদিন বলবো | আসলে তিব্বতী তন্ত্র-মন্ত্রের প্রতি আমাদের অতিরিক্ত আগ্রহের প্রথম এবং প্রধান. কারণ – ভাষার দুর্বোধ্যতা | ভাষাটা আমাদের কাছে সহজবোধ্য হলে আর এতটা আগ্রহ থাকতো না হয়ত | আমরা নিজের দেশের সংস্কৃত মন্ত্র গুলোর মানে বোঝার চেষ্টা করিনা অথচ চলি তিব্বতী পুঁথির রহস্য উদ্ঘাটনে | তিব্বতী ভাষাটা বুঝলেই দেখাযাবে আমাদের দেশের তন্ত্রসাধনার সঙ্গে বজ্রযানী তন্ত্র মন্ত্র দেব-দেবীর খুব বেশি তফাৎ নেই | আসলে দু’ধরণের মানুষ দুধরণের মানসিকতা নিয়ে একে গুহ্য সাধন-পদ্ধতি বলে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে চেয়েছেন সব সময় | একদল মনে করেছেন এই মন্ত্র গুলো সহজলভ্য হয়ে গেলে অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে পৌঁছবে , তখন তার অপব্যবহার হবে … এই যেমন কিছু লোক ” ১০ মিনিটে বশীকরণ , মারণ , উচাটনের বোর্ড লাগিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসেন … সেই শ্রেণীর লোকের হাতে এসব মন্ত্র গেলে তারা এর দ্বারা লোকের ক্ষতি করতে চাইবে | আবার সঠিক অর্থ না বোঝার কারণে ভুলভাল উচ্চারণে মন্ত্রের বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়ে যায় | এসব যাতে না হয় সেটা ভেবেই গুরু পরম্পরায় উপযুক্ত আধার খুঁজে তাকে সেই মন্ত্র দীক্ষা দেন |

আর দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা বেশিরভাগই ওই বোর্ড লাগিয়ে ব্যবসা করা শ্রেণী , যারা তন্ত্র এবং তান্ত্রিক দেবদেবী সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করে রাখতে চায় ব্যক্তিগত স্বার্থে |

চিনি বলে উঠলো – ” জানো দাদু , তোমার এই ভয় দেখানো শ্রেণীর ব্যবসাদার তান্ত্রিকদের কথা শুনে একটা কথা মনে পড়ে গেলো | ছোটবেলা মামারবাড়ি যেতে গেলে টালা ট্যাঙ্কের ওপরে একটা নামি দৈনিক সংবাদ পত্রের বিজ্ঞপন দেখতাম – তারা নাকি ঈশ্বর ছাড়া কাউকে ভয় পায় না | মা বলতো ” ঈশ্বর কি ভয় পাওয়ার জিনিস ??? চোর চ্যাঁচ্চোররা যেমন পুলিশকে ভয় পায় , পাপীরাও তেমন ঈশ্বরকে ভয় পায় | ও কি আর কোনো রকমে একটু ধুপ ঘুরিয়ে , দুটো এলাচদানা ছুঁড়ে দিয়ে কুলুঙ্গিতে তুলে রাখার জিনিস ? তাঁর আসন পাততে হয় অন্তরে , ভয় ভক্তির নয় প্রয়োজন ভালোবাসার | ভালোবেসে তাঁকে পরম প্রিয় আত্মার আত্মীয় ভাবতে পারলে তবেই তিনি ধরা দেন | “

ঠিকই বলেছে বৌমা , অনেক রাত হয়েছে চলো সব , এবার নিচে চলো | তোমাদের দিদুন কিন্তু অনেকক্ষণ খেতে ডেকে গেছে | ”

গলার কাছটায় ব্যাথা করছে হঠাৎ , এব্যাথা কার্তিকের হিমে ঠান্ডা লাগার ব্যাথা নয় | এতক্ষণ , চুপ করে গল্প শুনছিলাম । এবার একটা কথা মনের মধ্যে তোলপাড় করছে , আর সেটাই কষ্টের আকারে গলার কাছটায় দলা পাকাচ্ছে | মনে পরে গেলো “ছাতিফাটার মাঠ” … মনে পরে গেলো পোড়াকপালি সুরধ্বনির কথা | একে কন্যাসন্তান তায় আবার ছোটবেলাতেই “ বাপ্-মাকে খেয়েছে” ….. অপরাধ কি তার কম !! তাই খিদের জ্বালায় লোলুপ দৃষ্টিতে কারো খাওয়া দেখলে আর কপালে “ ডাইনী” বদনাম জোটে | ছোটবেলা থেকে তাকে বলা হয় যে সে তার কু নজর দিয়ে সবার ক্ষতি করে , রক্ত শুষে খায় | অসহায় সুরোধনির সবার দেওয়া এই অপবাদ বার বার শুনে শুনে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে লেগেছিল , ভাবতে লেগেছিলো যে তার নজর সত্যি খারাপ , সে ডাইনী | তারাশঙ্কর বাবু গল্পটা যে সময় লিখেছিলেন এখনো। .. এতো বছর পরেও তার খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে কি ? ডাইনী সন্দেহে পুড়িয়ে মারার ঘটনা তো এখনো খবরে উঠে আসে | 

“ ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যে রবিবার এক পরিবারের তিনজনকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় …” Apr 19, 2016 

“ ডাইনী সন্দেহে বৃদ্ধা নীলমণি মুর্মুকে বেধড়ক মার্ …. তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন “ – গোঘাট ২১ নভেম্বর ২০১৫ 

“ ঝাড়খণ্ডের এক গ্রামে ৭ অগস্ট পাঁচ মহিলাকে ডাইনি সন্দেহে পিটিয়ে মারা হল – ৮ই অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩

এসব ঘটনা গুলো খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায় প্রতি ক্ষেত্রেই সহায় সম্বলহীনা কিছু অসহায় মহিলা এই প্রথার বলি হয়েছেন আর বলি দিয়েছেন করা ? কিছু লোভী , অশিক্ষিত , কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ । কখনো অসহায় মহিলার ব্যাঙের আধুলি টুকু কেড়ে নেওয়ার জন্য , কখনো বা তাকে সহজলভ্য ভেবে ভোগ করতে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার শোধ নিতে , কখনো বা শুধুই দুর্বলের ওপর সবলের আধিপত্য দেখতে তাদেরকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছে …. কখনো পুড়িয়ে মারা হয়েছে |

একই শব্দ কখনো সম্মানের আবার কখনো অপবাদ | মনেপরে গেলো সুরধ্বনির করুণ স্বগতোক্তি – “ হে ঠাকুর আমার দৃষ্টিকে ভালো করে দাও , না হয় আমাকে কানা করে দাও “