নেশা-ভাং ও বাবার ‘পেসাদ’
পাতাটা দেখতে অনেকটা হাতের তালুর মতো ।হাতের তালুর সঙ্গে যেমন পাঁচটা আঙ্গুল জুড়ে থাকে , ঠিক তেমনি পাঁচটা অথবা সাতটা কিংবা. নয়টা বৃন্তহীন পত্রক একসাথে জুড়ে থেকে তৈরী হয় এক একটা পাতা , কিনারা গুলো খাঁজকাটা । গাছটার পোষাকি নাম ক্যানাবিস স্যাতিভা।নাম শুনে অচেনা লাগলেও এই পাহাড়ি গাছটির কথা আমরা সকলেই অল্পবিস্তর শুনেছি বোধহয় । ছোটবেলার রূপকথার গল্পের beloved রাজপুত্র রাজকন্যার প্রেমের উপাখ্যানে চিরাচরিত ব্যাগড়া প্রদায়িনী ডাইনীবুড়ির শণের নড়ির মতো চুলের বর্ণনা মনে নেই ? সেই শণের নড়ি বা দড়ি এই গাছটির থেকেই পাওয়া যায় । তবে শুধু শণ নয় আরো অনেক কিছুই পাওয়া যায় এর থেকে । এই গাছটারই শুকনো পাতা হচ্ছে ভাং বা সিদ্ধি, কাঁচা পাতা ও ফুলের রস শুকিয়ে গুলি করে হয় চরস, আর বাছাই করা কুঁড়ি ধরা অংশের কালচে-বাদামি রঙের আঠা থেকে হয় হাশিস । গাঁজা গাছ দু’রকমের। স্ত্রী গাছ আর পুরুষ গাছ। পুরুষ গাছের পাতায় তেমন নেশা হয় না। নেশা-ভাঙের জন্য স্ত্রী গাছের চাহিদা বেশি ।
তবে আজ নেশার দ্রব্য হিসেবে পরিত্যাজ্য হলেও ২৭৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লেখা চিনা সম্রাট শেন্ নুং এর লেখায় গাঁজার ভেষজ গুণ সম্পর্কে জানা যায় অনেক কথা । তাঁর মতে, বাতের ব্যথার উপশমে গাঁজার তুলনা নেই। আমাদের দেশে একসময় যখন কথায় কথায় ব্যাথার ওষুধ খাওয়ার প্রচলন ছিল না , সে সময়ে সন্ধ্যের দিকে বাতের ব্যাথার সাময়িক উপসমের জন্য অনেক প্রবীণরা আফিমের নেশা করতেন । এও কতকটা সেই রকমই । শুনতে অবাক লাগলেও একাগ্রতা বাড়াতেও নাকি গাঁজার ব্যবহার হয় – এমন কথাও শেন নুঙের লেখা থেকে জানা যায়। শুধু চীন দেশে নয় আমেরিকাতেও বহু ওষুধ তৈরিতে এর ব্যবহার হয়ে থাকে । তবে মূলত মেক্সিকো থেকে আমদানি করা এই মারিজুয়ানার ওপরে শুল্কের মাত্রা ছিল চড়া , একশো ডলারের মারিজুয়ানার ওপরে প্রায় একশো ডলার বিক্রয়কর দিতে হতো । যার ফলে চোরা পথে বিভিন্ন দেশ থেকে আসত এই সব নেশার দ্রব্য ।
বিশিষ্ট সাংবাদিক পিনাকী ভট্টাচার্যের একটি লেখা থেকে জানা যায় আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আশেপাশে লেখা অথর্ব বেদে ভাং-কে পবিত্র ঘাস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে , আর শিবঠাকুরের প্রিয় নেশা বলে তা তাঁকে নিবেদনের কথাও সেখানে উল্লেখ আছে ।
আনুমানিক ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দেখা যাচ্ছে মধ্য এশীয় স্কাইথিয়ান গোষ্ঠী শণের পোশাক ও দড়ি ব্যবহার করত যা তৈরী হতো এই ক্যানাবিস স্যাটিভা বা মারিউয়ানা ( marijuana) গাছকে শুকিয়ে। ক্রমে ক্রমে তারা দেখলো আগাছা বা weed জাতীয় এই গাছটি থেকে শুধু যে শনের নুড়ি বা দড়ি ও পোশাকই বানানো যায় তাই না, এই গাছের পাতাতে নেশাও হয় চমৎকার। পঞ্চম খ্রিস্টপূর্বাব্দে, গ্রিক দার্শনিক হেরোডোটাসের লেখায় স্কাইথিয়ানদের গাঁজা টানার অভ্যেসে কথা আছে । তার দুশো বছরের মধ্যে গ্রিকরাও গাঁজার ব্যবহার এবং শণের তৈরি পোশাক পরায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে ।
ভোলেবাবার অনুচরেরা অনেকেই হয়তো জানেন যে শিবের বাসভূমি কৈলাস পর্বতের আসে পাশে অৰ্থাৎ হিমালয়ের পাহাড়ি অঞ্চলের বেশ কিছু জায়গার আবহাওয়া এই গাছের পক্ষে অনুকূল । তবে এসব অঞ্চলে মারিয়ুয়ানা ( Marijuana ) নিজে থেকেই জন্মায় ও কোনো পরিচর্যা ছাড়াই বেড়ে আগাছার মতো ওঠে । হ্যাঁ , এই গাঁজা গাছকেই মেক্সিকান ভাষায় বলা হয় মারিয়ুয়ানা বা মারিজুয়ানা । হিমাচলের কুলুর পার্বতী ভ্যালির কাছে এমনি একটা গ্রাম আছে, যার নাম “মালানা” । তথাকথিত সভ্য জগৎ এর ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলা এই অদ্ভুত গ্রামের বাসিন্দারা আবার নিজেদের আলেকজান্ডারের সৈন্যদের বংশধর বলে দাবি করেন অর্থাৎ কিনা গ্রীক। তারা নিজেদের যমদগ্নী ঋষির অনুগামী বলে মনে করে । কয়েক বছর আগে ডেট্রয়েট থেকে Dakota Wint নামে একটি আমেরিকান ছেলে ওই গ্রামে যায় এবং তাদের জীবনযাত্রার ওপরে একটা তথ্যচিত্র বানায় এবং তার পর থেকেই এই মালানা গ্রাম ধীরে ধীরে বহুচর্চিত হয় । তার আগে পর্যন্ত এই গ্রামটি ছিল সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে । কারণ অতি দুর্গম এই ছোট্ট পাহাড়ি জনপদটি যাতায়াত ব্যবস্থা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতিকূলতার কারণে বহুকাল ছিল শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত । ড্যাকোটার তথ্যচিত্রের পর কিছু “সানসানি খেজ” খবর বানানো হিন্দি tv চ্যানেল গুলো পৌঁছে যায় মালানা গ্রামে , এবং তাদের সবার সৌজন্যে সেখানে বাড়তে থাকে দেশি বিদেশী নেশুড়ে পর্যটকদের ভিড়। গাঁজা , চরস , মালানা ক্রীম ( চরস ) , মালানা ব্রাউনি প্রভৃতি নেশার দ্রব্যের টানে এখন বহু বিদেশী পর্যটক ছুটে আসে । তবে এসব ব্যবসার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই কোননা কোনো রাঘববোয়ালের পাকা মাথা কাজ করে । অতিরিক্ত প্রচারের আলো তাদের কাজের ব্যাঘাত ঘটায় ।
আমাদের দেশে গাঁজা টানার সঙ্গে ধর্ম-কর্ম মিলেমিশে একাকার। সাধু-সন্ন্যাসীদের নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইতে ভোলানাথের চ্যালাদের সেই ‘তুরীয় আনন্দ’-এর কথা আছে। এই গঞ্জিকাকে তাঁরা অনেকেই সমীহ করে বলেন – “ বাবা কা পরসাদ “। তবে রূপচাঁদ পক্ষীর কৃপায় যবে থেকে কলকাতা শহরে বাসা বাঁধলো “ পক্ষীর দল”, তৈরি হল, হাফ-আখড়াই, জেলেপাড়ার সঙ , তবে থেকে এই বাবার প্ৰসাদের ওপরে আর সাধু সন্ন্যাসীদের একচেটিয়া অধিকার রইল না । পক্ষী হওয়া সহজ ছিল না মোটেই । যে গেঁজেল টানা ১০৮ ছিলিম গাঁজা খেতে পারতেন, তাঁকে একটা ইট দেওয়া হত। এ ভাবে পাওয়া ইট দিয়ে যিনি ঘর তুলতে পারতেন, তাঁরই ‘পক্ষী’ খেতাব জুটত।
বাউলরাও গাঁজাকে বড়ই আদর-ইজ্জত দেন বলে শোনা যায় । শ্মশানের বড় কলকের বদলে তাঁরা ভালবাসেন ছোট কলকে , যাকে তারা বলেন ‘বাঁশি’। তামাক বা দোক্তা পাতা যেমন থান ইঁটের মতো দেখতে কাঠের টুকরোর ওপর রেখে কাটা হয়, তেমনি শুকনো গাঁজার পাতা যে কাঠের টুকরোর ওপর রেখে গাঁজা কুচানো হয়, তাকে তাঁরা বলেন ‘প্রেম তক্তি’, আর গাঁজা কাটার ছুরিকে বলেন ‘রতনকাটারি’ , কলকের তলায় জড়ানো কাপড়ের টুকরো হল ‘সাফি’।
হালফিলে শুধুমাত্র শিবরাত্রের দিনেই নয় , দোলের দিনে বসন্ত উৎসব পালনের সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধি বা ভাঙের “থিম পার্টি”রও প্রচলন হয়েছে । কলকাতায় বেশ পুরোনো কতগুলো সিদ্ধির ঠেকও রয়েছে । সবগুলোই যে ভালো মানের নির্ভরযোগ্য সিদ্ধি বিক্রি করে এমন নয় । অনেক দোকানে কড়া নেশার জন্য “ট্যাবলেট” মেশানো খড়ি গোলা জলের স্বাদের জঘন্য সিদ্ধিও পাবেন । তবে ভালো স্বাদের ভালো মানের সিদ্ধির দোকানও আছে ।
আমার “সিদ্ধিলাভ” হয়েছে অনেক ছোটবেলাতেই । ঘাবড়াবেন না , ব্যাপারটা তাহলে একটু খোলসা করে বলি । আমার মামারবাড়িতে দুর্গাপুজো হয় । আর পাঁচটা পুরোনো বনেদী বাড়ির দুগ্গাপুজোর মতো সেবাড়িতেও পুজোর সাত-সতেরো নিয়ম । তারমধ্যে একটা হল বিজয়া দশমীর দিনে প্রতিমা বিসর্জনের পরে সিদ্ধি খাওয়া ।
দশমীর দিন সকাল থেকেই সিদ্ধি বানানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় আমাদের। সকালে মাসতুত দাদারা ও মামাতো ভাইয়েরা বড়বাজার থেকে সিদ্ধির সরঞ্জাম কিনে আনে, আমিও সুযোগ বুঝে ওই দলে ভিড়ে যাই । তার কারণ অবশ্য একটা আছে । বড়বাজারে কলাকার স্ট্রিটে জৈন মন্দিরের কাছে সত্যনারায়. পার্ক .এ.সি মার্কেটের ঠিক উল্টো দিকে যে ভাঙের দোকান থেকে কাঁচা ভাঙ কিনতে যাওয়া হয় সেখানে অপূর্ব ঠান্ডাই বিক্রি হয় । কিনতে গিয়ে সবাই সে ‘পেসাদ’ পায় । এক ধারে ক্যাসকাউন্টার , সেখানে আগাম টাকা মিটিয়ে কুপন কাটার বন্দোবস্ত। তার পরে চাহিদামাফিক শরবতের জন্য দোকানের সামনে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করা । দাম সব শরবতেরই এক। কিন্তু বন্দোবস্ত তিন ধরণের – দুধের সর ভরপুর হালকা হলুদরঙা শরবতটি নিৰ্ভেজাল ঠান্ডাই , ওতে ভাং থাকে না । কিন্তু হলুদের রংটা একটু একটু করে ফিকে হয়ে কালচে হতে শুরু করেছে আরও দু’ধরনের গেলাসে। তেনারা হলেন গিয়ে ক্রমান্বয়ে ‘মিডিয়াম’ ও ‘কড়ওয়া’ শরবত ।
দশমীর দিনে ঠাকুর বরনের আগেই সিদ্ধি তৈরী হয়ে যায়। তবে ঠাকুর যতক্ষণ পর্যন্ত না বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে, এক ফোঁটাও কারোর চেখে দেখার অনুমতি নেই ।

বিসর্জনের পর সবাই গঙ্গা থেকে ফিরলে কলা পাতায় ” ওঁ শ্রী শ্রী দুর্গা মাতা সহায় ” লিখে, দুর্গা বেদী সাত বার প্রদক্ষিণ করে শান্তি জল নেবার পর বড়দের প্রনাম করা হলে তবে মিষ্টি আর সিদ্ধি খাওয়া হয় । মিষ্টির মধ্যে থাকে দেশবন্ধুর সীতাভোগ, মিহিদানা, চারুচন্দ্রের মাতৃভোগ , কুঁচো নিমকি, জিভে গজা প্রভৃতি সঙ্গে ঘুগনি ।
এই দিন বাড়ির আবালবৃদ্ধবনিতা একত্রে সিদ্ধি লাভ করেন। এক বারের একটা অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ল , বলেই ফেলি। একবার হয়েছে কি , পান-ভোজনের শেষে সব ভাইবোন মিলে খাটের ওপর গোল হয়ে বসে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া হচ্ছে । ভগবান আমার গলায় সু. দিতে ভুলে গেছেন , তাই আমি নির্বাক শ্রোতা। দাদা গাইছে আর আমারা সবাই চোখ বন্ধ করে গান শুনছি । এমন সময় হঠাৎই মাঝপথে গান থেমে যেতে তাল কেটে গেল । চোখ চেয়ে দেখি সবাই আমার দিকে তাকিয়ে খ্যাক্ খ্যাক্ করে হাসছে ।ব্যাপার টা হল, দাদা হঠাৎ গান গাইতে গাইতে লক্ষ্য করে আমি নাকি বেশ অনেকক্ষণ ধরেই চোখ বন্ধ করে আপন খেয়ালে “dumb charades” এর মত গান টা বোঝাচ্ছি ।
কখনও চিঠি লেখার মতো করে লিখছি ….
কখনও বা ধুপ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুজো করছি ।
গানটা ছিল-
” ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে ” ।
তবে ব্যক্তিগত ভাবে , সিদ্ধি খেলেই যে ধরণের অনুভূতি হয় তাকে ঠিকঠাক শব্দে প্রকাশ করতে পারে আরেকটা গান –
“ আজ কাল পাঁও জ( z )মি পর নেহি পড়তে মেরি
বোলো দেখা হ্যায় কাভি তুমনে মাঝে উড়তে হুয়ে ??? “ 😘