গল্প

কল্পতরু শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপাধন্য গিরিশ

বেলা পড়ে আসছে, লাল সূর্য যেন মুঠো মুঠো আবির ছড়িয়ে দিচ্ছে বাগবাজারের গঙ্গার জলে | আর সেই সঙ্গে অপরাহ্নের ম্লান আলো গিরিশবাবুর মনের বিষাদকে বাড়িয়ে দিচ্ছে আজ | গিরিশ ঘোষ – বঙ্গরঙ্গমঞ্চের মুকুটহীন সম্রাট , আজ শোকে ভারাক্রান্ত | আজ তাঁর পুত্র মারা গেছে। ছোট্ট শিশুপুত্র কয়েক বছরমাত্র ছিল যার আয়ু। কিন্তু এই কয়েক বছরে সে গিরিশকে অনেক ভাবিয়েছে। বেশ কয়েক বছর হল ঠাকুর দেহ রেখেছেন, গিরিশের মন ভার | যতদিন ঠাকুর বেঁচে ছিলেন ততদিন গিরিশবাবু তাঁর শোকগ্রস্থ মন নিয়ে বারবার ছুটে গেছেন শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে, শান্তির বারিধারার সন্ধানে | এযাবৎ অনেকগুলি অকালমৃত্যু দেখেছেন গিরিশবাবু। সেই ছোট্টবেলায় প্রথম হারিয়েছিলেন নিজের থেকে বছর দু’য়ের বড় ‘গিরিভাই’ অন্তপ্রাণ দিদি প্রসন্নকালীকে। সেই প্রিয় দিদিকে দিয়ে শুরু …..তারপর একে একে হারিয়েছেন দাদা ক্ষীরোদচন্দ্র , দিদি কৃষ্ণভামিনী , নিজের প্রথম শিশুপুত্র , এমনকি হারিয়েছেন নিজের স্ত্রীদেরও , কয়েকবছর আগে হারিয়েছেন ঠাকুরকে – যার জন্য নিজের ভাবজগতে পরিবর্তন এসেছিল বাউণ্ডুলে-মদ্যপ গিরিশের সেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও তাঁর পাশে আর নেই আর।
…. আর এবার সবচেয়ে প্রিয় শিশুপুত্র |

পুত্রের মৃত্যুতে গিরিশ এত কেন ভেঙে পড়লেন? গিরিশ আসলে তাঁর ছোট্ট পুত্র সন্তানটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী গত হওয়ার পর এই দুধের শিশুটিকে আঁকড়ে ধরেই সমস্ত বিয়োগব্যাথা ভুলতে চেয়েছিলেন তিনি । একাধারে তিনিই ছিলেন ওর বাবা ও মা | শিশুটি যখন মাতৃগর্ভে তখন তার দ্বিতীয়া স্ত্রী হঠাৎ করে মাঝেমাঝেই হরিবোল হরিবোল বলে চিৎকার করে উঠত| কুলবধূর এইরকম আচরণে তাকে বাড়ির লোকের গঞ্জনাও শুনতে হত | ভূমিষ্ট হবার পরই মাতৃহারা হওয়ায় বাবা ও পিসিমা দক্ষিণাকালীর কাছেই প্রতিপালিত হতে থাকে গিরিশের শিশু | ছোট থেকেই তার মধ্যে অদ্ভুত সব আচরণ লক্ষ্য করেন অনেকেই | শিশুটি অন্য কারোর কোলে যেতে না চাইলেও শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যদের কোলে পরমানন্দে ঝাঁপিয়ে পড়ে | ঠাকুর দেবতার মূর্তি নিয়ে খেলতে পছন্দ করে , অনেক সময় তাকে ঠাকুরের মূর্তির সামনে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে দেখা যায় | একবার হয়েছে কি , ঘরের দেয়ালে টাঙানো পরমহংসদেবের ছবির দিকে তাকিয়ে সে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলো | কিছুতেই তাকে শান্ত করা যায় না , খিদে পেয়েছে ভেবে খাবার জিনিস দেওয়া হলো , তাতেও ছেলের কান্না থামে না , খেলনা দিয়ে ছেলে ভোলানোর চেষ্টা করা হল , তাতেও কিছু লাভ হল না | তার হাবভাব দেখে সবাই ভাবলে সেবুঝি দেওয়ালে টাঙানো ছবিটা পেড়ে দিতে বলছে | ছবি পাড়তে গিয়ে দেখা গেলো ছবির ফ্রেমের পিছন দিকে লাল পিঁপড়ে থিকথিক করছে | আশ্চর্যের বিষয় , পিঁপড়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করে ছবিটি আবার দেওয়ালে টাঙিয়ে দিতেই ছেলের কান্না গেল থেমে , দিব্যি আগের মত হাসিমুখে খেলতে লাগলো |

অবগুণ্ঠনবতী গুরুপত্নীর সঙ্গে গিরিশ ঘোষের প্রথম সাক্ষাৎ হয় এই শিশুটির কারণেই। মা তখন বরানগরের কুঠিঘাটার সৌরেন্দ্রমোহন ঠাকুরের ভাড়াবাড়িতে থাকেন। একদিন সপুত্রক গিরিশবাবু এলেন মাতৃদর্শনে। মা’কে দেখার জন্যে সেছেলে এমন অস্থির হলো, যে উপরে যেখানে মাসারদা ছিলেন —সকলকে টেনে টেনে সেই দিকে “উ উ “করে দেখিয়ে দিতে লাগলো। প্রথমে কেউ বোঝে নি, শেষে বুঝতে পেরে মাসারদাদেবীর কাছে নিয়ে গেলো তাকে ,তখন ঐ টুকু ছেলে মায়ের পায়ের তলায় পড়ে প্রণাম করলে। তারপর নীচে নেমে তারবাবাকে ধরে টানাটানি — সারদামণির কাছে নিয়ে আসবে বলে । সে তো হাউ হাউ করে কেঁদে বলে ‘ওরে আমি মাকে দেখতে যাবো কি –আমি যে মহা পাপী।’ছেলে কিন্তু কিছুতেই ছাড়ে না । তখন ছেলে কোলে করে কম্পিত বখে সাশ্রুনয়নে মা’র পায়ে সাষ্টাঙ্গ হয়ে পড়ে বলে ,”মা এ হতেই তোমার শ্রীচরন দর্শন হলো আমার ।”
এরপরেও মা সরদার সঙ্গে বেশ কয়েকবার শিশুটির দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। প্রত্যেক বারেই সে মায়ের কোলে বসে এমন স্বচ্ছন্দে খেলে যেন আত্মার আত্মীয়।

অল্পদিনের মধ্যেই শিশুটি ধীরে ধীরে শীর্ণকায় ও দুর্বল হয়ে যেতে লাগল | ডাক্তার-বদ্যি করেও কোনো লাভ হল না | কি যে তার কষ্ট বোঝা যায় না অথচ রোগ যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে | তখন একমাত্র হরিনাম করলেই শান্ত ধীরস্থির হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে | ছেলের এইসব লক্ষণে গিরিশ ঘোষের ধারণা জন্মেছে যে ভক্তবাঞ্ছাকল্পতরু পরমহংসদেব তার মনের ইচ্ছে পূর্ণ করতেই তার ঘরে তার ছেলে রূপে ফিরে এসেছেন | মাঝে মাঝে তাই গিরিশ ভুলে যান যে সে তার নিজের সন্তান | তার কেবলই মনে হতে থাকে “এই দেবশিশু তাঁর গুরু ঠাকুর রামকৃষ্ণ ছাড়া আর কেউ নন |” ঠাকুরকে পুত্রভাবে চেয়েছিল সে , ঠাকুর তাতে বলেছিলেন ‘হ্যাঁ বয়ে গেছে আমার তোর ছেলে হয়ে জন্মাতে। ঠাকুরের শরীর যাবার কিছুকাল পরেই যখন এ ছেলে জন্মালো তখন ওরা তাকে ঠাকুরের মতো সেবা করতো। তার কাপড় জামা , খাবার জন্যে রেকাব , বাটি , গেলাস সমস্ত জিনিস পত্র নতুন করে দিলে–সে সব আর অন্য কাউকে ব্যাবহার করতে দিতো না। গিরিশ বলতো “ঠাকুর ই এসেছেন” তা ভক্তের ইচ্ছাপূরণে কল্পতরু হয়েছেন ভগবান।

এহেন ছেলের অসুস্থতার কারণে গিরিশের থিয়েটারে যাওয়া প্রায় বন্ধের মুখে | গিরিশের নিজেরও শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছে না ইদানিং | তার ওপর আবার নবকুমার রাহা নাম এক ‘ অবৈতনিক ‘ সেক্রেটারী জুটেছে ষ্টার থিয়েটারে , তারই উস্কানিতে থিয়েটারের অধিকারিকগণ গিরিশ্চন্দ্রকে পদত্যাগ পত্র পাঠিয়েছে | এমন বিষাদ আর নৈরাশ্যের দিনে গিরিশ বাবু ঠিক করলেন ছেলেকে নিয়ে মধুপুরে যাবেন হাওয়া বদলে , যদি তাতে কিছু উন্নতি হয় ছেলের স্বাস্থ্যের | মধুপুরে থাকাকালীন তার কানে এল ষ্টার থিয়েটারের সত্ত্বাধিকারীরা তার নাম হাইকোর্টে অভিযোগ দায়ের করেছে | পত্রপাঠ অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে ফিরলেন কলকাতায় | এসময় তার মনে হল হয়তো এই দেবশিশুর ওপর সমস্ত অধিকার বা স্বত্ব ত্যাগ করলে তাঁকে বাঁচানো সম্ভব | একদিন গেলেন তাঁর প্রিয় নরেনের কাছে। নরেন তখন অবশ্য বিশ্বখ্যাত বিবেকানন্দ হয়ে গেছেন।কিন্তু গিরিশের কাছে সেই বন্ধুসুলভ-ভাইসুলভ গিরিশ। গিরিশ পুত্রের এই অলৌকিক ক্ষমতার কথা জানালেন বিবেকানন্দকে | স্বামিজী শুনে চমকে উঠলেন। গিরিশ অনুরোধ করলেন স্বামীজীকে বললেন, “ আমার শিশুটিকে সন্ন্যাসমন্ত্রে দীক্ষা দাও। ওকে তোমাদের দলভুক্ত করে নাও ।” স্বামীজীও বিষয়টির গুরুত্ব বুঝলেন। উপেক্ষা করতে পারলেননা গিরিশের অনুরোধ । স্বামীজী শিশুটির কানে বীজমন্ত্র দিলেন । তবুও শেষরক্ষা হল না, ‘স্বর্গীয় সেই কুসুম’ দিনে দিনে শুকিয়ে যেতে লাগল । অবশেষে এল সেই দিন যেদিন সত্যি সত্যিই গিরিশচন্দ্রের ” সাজানো বাগান শুকিয়ে গেলো “। মাত্র চার বছর বয়সে সেই দেবশিশু ইহলোকের মায়া কাটিয়ে নিজধামে ফিরে গেল আবারও চলে গেল গিরিশের ‘ঠাকুর’ ।

তথ্যসূত্র : গিরিশচন্দ্র – অবিনাশ চন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় , শ্রী শ্রী মায়ের কথা |