ক্ষীরমোহন
দীর্ঘ দুবছরের আইনি লড়াইয়ের পর ২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর তারিখে, রসগোল্লার GI tag পেয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ এ গল্পটা এতদিনে সবাই জেনে গেছেন। কিন্তু এই দু’দুটো বছর কলকাতার রসগোল্লার বিপক্ষে আদালতে যিনি হাজিরা দিচ্ছিলেন, সেই তাগড়াই বিবাদীপক্ষটিকে নিয়েই আজকের গল্প।
উৎকলবাসীরা মনে করেন রসগোল্লার উৎপত্তি পৌরাণিক যুগে। ভাইবোনেরা মিলে রথে চড়ে মাসীর বাড়ি ছুটি কাটিয়ে পুরীর মন্দিরে ফিরে জগন্নাথদেব দেখেন তাঁর লক্ষীদেবী অর্থাৎ বিমলা মুখ হাঁড়ি করে জগন্নাথ দেবের দোর আগলে বসে আছেন৷ সত্যিইতো, তাঁকে মন্দিরে ফেলে রেখে সবাই রথযাত্রায় মেতেছিল এতদিন, রাগ হওয়া খুব স্বাভাবিক। তখন জগন্নাথদেব তাঁকে রসগোল্লা খাইয়ে মানভঞ্জন করেছিলেন৷ আর সেই পৌরাণিক রসগোল্লার নামই হল – ‘ ক্ষীরমোহন ‘।
পুরীতে রথযাত্রা আনুমানিক ৬০০ বছরের পুরনো। তারমানে রথযাত্রার শেষে ‘শীতলভোগ’ হিসেবে নিবেদিত এই ক্ষীরমোহনও বয়েসে বেশ প্রবীণ।
সম্প্রতি তৌষিক বসুর ফেসবুক প্রোফাইলে কাগজের ডোঙ্গায় লালচে রঙের রসগোল্লার মত দেখতে কতগুলো মিষ্টি দেখে আমার ‘পেটুক’ মন কৌতুহলী হয়ে পরে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারি , লোকাল ট্রেনে নবদ্বীপ যেতে গেলে ট্রেনে যে সব ফেরিওয়ালাদের দেখা পাওয়া যায় এ মিষ্টি তাদের থেকেই কেনা, নাম – ক্ষীরমোহন। মনে পরে গেল , একবার আমার দাদা বৌদির সঙ্গে ট্রেনে করে কৃষ্ণনগর যাচ্ছিলাম, মায়াপুর যাব বলে। ট্রেনে মিষ্টিওয়ালা উঠেছিল , কাঁসার বড় থালায় থরে থরে মিষ্টি সাজানো এই মিষ্টি আর কাঁচাগোল্লা। আমি আর দাদা কাঁচাগোল্লা খেয়েছিলাম। টাটকা ছানায় তৈরি কাঁচাগোল্লার গন্ধ শালপাতার গন্ধের সঙ্গে মিশে এক মায়াবী গন্ধ সৃষ্টি করেছিল, যা চোখ বুজে নাকে টের পাই এখনো। নবদ্বীপ , গুপ্তিপাড়া, সোমড়াবাজার এলাকায় এই লকাল ট্রেনের মিষ্টি বিক্রেতাদের বাস। এবার মনে প্রশ্ন এলো, তা হলে, এই ওড়িয়া ক্ষীরমোহন কালনা-কাটোয়া বা শান্তিপুর, কৃষ্ণনগর শাখার ট্রেনে ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করছে কেন ?
লালমোহন বাবুর ভাষায় ক্ষীরমোহনকে ‘কালটিভেট’ করতে গিয়ে যোগসূত্র হিসেবে যার কথা প্রথম মাথায় এলো তিনি হলেন – নদের নিমাই। জনশ্রুতি, ভোজনরসিক শ্রী চৈতন্য পুরীর এই ক্ষীরমোহনের স্বাদে এমন মোহিত হলেন যে লোকমুখে সেই মিষ্টির কথা ছড়িয়ে পড়ল নবদ্বীপ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায়। ফুলিয়ার জনৈক হারাধন ময়রা সেখান থেকে শিখে এসে বানালেন বটে ক্ষীরমোহন কিন্তু, সেই পুরীর ক্ষীর মোহনের স্বাদ তাতে এলো না।
আবার, শংকরের লেখা ‘রসবতী’ থেকে জানা যায় রানাঘাটের হারাধন ময়রা ১৮৪৬ /৪৭ সালে স্থানীয় জমিদার পাল চৌধুরীদের জন্য উনি এই মিষ্টি বানান , জমিদার মশাই মিষ্টান্নের নামকরণ করেন রসগোল্লা।
ওড়িশার পাহালা-সোলেপুর অঞ্চল “ওড়িয়া রসগোল্লা” বা ক্ষীরমোহনের পীঠস্থান। সেখানে যে ক্ষীরমোহন তৈরী হয় তা সমড়া বাজার , গুপ্তিপাড়া বা নদীয়ায় তৈরী ক্ষীরমোহনের চেয়ে কিছুটা আলাদা।
ওড়িয়া ক্ষীরমোহনের পেটের ভিতরে কেশর যুক্ত খোয়াক্ষীর , চিনি ও বাদাম গুঁড়োর মিশ্রণ পুর হিসেবে ভরা থাকে। অবশ্য ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে লেখা বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘মিষ্টান্ন পাক’ বইতে ক্ষীরমোহনের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা পাহালা-সোলপুরের ক্ষীরমোহনের মতোই। তাই মনে করা যেতেই পারে ব্যবসায়িক কারণে লোকালট্রেনের ক্ষীরমোহন খোয়াক্ষীরের দাক্ষিণ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
🔴 এবার দেখে নেওয়া যাক ক্ষীরমোহন বানাতে কি কি লাগছে –
১) ১ লিটার দুধ ( full fat milk )
২) ৪ টেবিল চামচ টকদই ( ছানা কাটানোর জন্য )
৩) ২ চামচ সুজি
৪) ১ চা চামচ ময়দা
৫) ১ চিমটে বেকিং পাউডার ( optional )
৬) পুর বানানোর জন্য লাগবে আধা কাপ গুঁড়োনো খোয়াক্ষীর , এক চামচ আখরোট গুঁড়ো , এক চামচ কাজু গুঁড়ো ( গুঁড়ো গুলো খুব মিহি হবে না )
৭) চিনির রসের জন্য দেড় কাপ চিনি , ও ৪ কাপ জল ও ৩/৪ টে ছোট এলাচের গুঁড়ো।
🔴 ক্ষীরমোহন বানানোর পদ্ধতি –
১) দুধ ফুটে উঠলে আগে থেকে ফেটিয়ে রাখা টক দই দিয়ে ছানা কাটিয়ে সেটা খুব সুক্ষ ছিদ্রযুক্ত ছাঁকনি বা সুতির কাপড়ে করে জাঁক দিয়ে তাতে সুজি , ময়দা আর বেকিং পাউডার এবং ১ চামচ চিনি মিশিয়ে হাতের তালু দিয়ে চেপে চেপে ভালো ভাবে মিশিয়ে ১ ঘন্টার জন্য ঢাকা দিয়ে রেখে দিতে হবে।
২) খোয়াক্ষীরের সঙ্গে সামান্য চিনি ও বাদাম গুঁড়ো মিশিয়ে পুর তৈরি করে নিতে হবে।
যদি ঝুরো পুর ভরতে অসুবিধে হয় , তবে মিশ্রণ টা সামান্য গরম করে গলিয়ে ছোট ছোট বলের আকারে বানিয়ে নিতে পারেন।
৩) রস তৈরির জন্য , আগে ৪ চামচ চিনি ও এক চামচ জল দিয়ে গরম করে লালচে ক্যারামেল বানাতে হবে ,
এবার ওই পত্রেই বাকি চিনি ও জল দিয়ে ফুটিয়ে লালচে রস বানাতে হবে। তবে রস যেন পাতলা হয়।
৪) এবার , ছানার মিশ্রণটা আর একবার ভালো করে মেখে বা ঠেসে নিয়ে সমান মাপের ৭ বা ৮ টা বল টি করতে হবে।
৫) এরপর , কচুরির পুর ভরার মতো করে তার মধ্যে ক্ষীরের পুর গুলো ভরে দিতে হবে।
৭) এবারে ক্ষীর ভরা ছানার বল গুলো লালচে চিনির রসে দিয়ে আধ ঘন্টা থেকে ৪৫ মিনিট ফোটাতে হবে।
৮) এর পরের ধাপটা দু ভাবে করা যায়। ঘন চিনির রসের কোটিং ঠান্ডা হলে রসগোল্লার গায়ে দানাদারের মতো আস্তরণ তৈরি হবে।
আর সেটা না চাইলে ঘন রসে কিছুটা গরম জল ঢেলে দিল ক্ষীরমোহনের গায়ের ঘন রস ধুয়ে যাবে।
তখন বাইরে থেকে বোঝা যাবে না যে ক্ষীরমোহনের অন্তর রসে পরিপূর্ণ।

‘কৃতজ্ঞতা স্বীকার’ আমার লেখার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ যেটা বাদ দিলে লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
ক্ষীরমোহন সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য আমি যে সব বই থেকে পেয়েছি তার সব কটাই “মলাট” নামক ফেসবুক গ্রুপ থেকে নেওয়া, এর জন্য আমি Rohit Sen এর কাছে কৃতজ্ঞ। উনি নিজেও তথ্য অনুসন্ধানে অনেক সাহায্য করেছেন।
এছাড়া যে দুজন মানুষ লেখালিখি নিয়ে আমার যাবতীয় উদ্ভট প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সবসময় সাহায্য করেন , তাঁরাতো আছেনই – শ্রী গৌতম বসুমল্লিক ( Gautam BasuMullick ) এবং শ্রী অমিতাভ পুরকায়স্থ ( Amitava Purakayastha )।
এছাড়াও , শ্রী চৈতন্য দেবের ক্ষীরমোহনপ্রীতির কথা জেনেছি ‘ নুনেতে ভাতেতে ‘ বইয়ের লেখক শ্রী রামকৃষ্ণ ভট্যাচার্য্য সন্যালের থেকে।
