রান্না

চিঁড়া জিরা বা চিকণ চিঁড়া এবং ‘চিনি বেত্তান্ত’

আচ্ছা, যদি প্রশ্ন করি চিনির নাম কেন চিনি হল ? কি বলবেন ? অনেকেই বলবেন তাং আচিউ ওরফে ইয়াং তা চাও এর নাম, যিনি হেস্টিংসের আমলে ( ১৭৭৮ সালে ) বজবজের নদী তীরবর্তী অঞ্চলে কয়েকজন বন্ধুদের নিয়ে আস্তানা গেড়েছিলেন এবং সঙ্গে আনা চিনা চা খাইয়ে মন জয় করে নিয়েছিলেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের। চায়ের সুবাসে মাতোয়ারা হেস্টিংস সাহেব তাকে দিয়েছিলেন বাসযোগ্য জমি ও ভারতে ব্যবসা করার ছাড়পত্র। যদিও তার প্রাথমিক ইচ্ছা ছিল চায়ের ব্যবসা করা কিন্তু ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে তাং আচিউ এর হাতেই বজবজে গড়ে ওঠে ভারতে প্রথম চিনি মিল।
তবে, গল্পটা এতো সহজ নয়। চিনাদের চিনি মিলে প্রথম অপরিশোধিত লালচে ভারতীয় চিনির সঙ্গে ফসফেট মিশিয়ে কেলাসিত ( bleaching and crystallization ) করে তৈরী হয় শুদ্ধ স্বচ্ছ আধুনিক চিনি। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে চিনির অস্তিত্বের উল্লেখ পাওয়া যায় তাং আচিউ এর ভারতে আসার ২৪০০ বছর আগে অর্থাৎ যীশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৬০০ বছর আগে। একথা আমি বলিনি , বলেছেন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় তার লেখা ‘বাঙালির ইতিহাস’ আদিপর্বে। যে সময়ের কথা বলছি সেকালে বারাণসী নগরে পুণ্যতোয়া গঙ্গার তীরে বাসকরতেন এক ঋষি , যাকে আধুনিক শল্যচিকিৎসার জনক বলে মানা হয়, নাম তার সুশ্রুত। তাঁর গ্রন্থে পৌন্ড্রক নামের আখ থেকে প্রচুর পরিমানে চিনি উৎপন্ন হবার কথা লেখা আছে।

1533079205331
বাঙালির ইতিহাস আদি পর্ব – নীহাররঞ্জন রায়

আবার গুপ্তযুগে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালে প্রাচীন তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতির অধ্যাপক চাণক্য তাঁর লেখা অর্থশাস্ত্রে ৫ ধরণের মিষ্টত্ব প্রদানকারী উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা –
১) ফানিতা ( আখের রস )
২) গুড়
৩) খণ্ড ( আখের রস থেকে তৈরী মিছড়ি )
৪) মৎসানদিকা
৫) শর্করা
এর মধ্যে খণ্ড বিদেশে রপ্তানী করা হত। মনে করা হয় এই খণ্ডই বিদেশী উচ্চারণে অপভ্রংশ হয় candy হয়েছে।

ভাবছেন, মুচমুচে চিঁড়া জিরার লোভনীয় রেসিপি লিখতে গিয়ে চিনির জীবনবৃত্তান্ত লিখছি কেন ?
কারণ , চৈতন্যপ্রয়াণের শতবর্ষ পরে কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী লিখিত আকরগ্রন্থ চৈতন্য চরিতামৃতে চিনি পাকে তৈরী হুড়ুম চূর্ণের নাড়ু , গঙ্গাজলি ও চিঁড়াজিরার কথা পড়ে আমার চিনির জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে কৌতূহল জাগে। আর তার সূত্রধরেই এই ‘ চিনি বেত্তান্ত’।

PSX_20180730_122950
চৈতন্য চরিতামৃত – কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী

তবে আমার মনে হয় চৈতন্যদেবের সময়ে আখের রস জ্বাল দিয়ে বা শুকিয়ে বানানো ঈষৎ লালচে রঙের অপরিশোধিত চিনির গাদ তুলে ফেলে দিয়ে অমন চিকণ চিকণ মিষ্টি বানানো হতো। চিনি ফোটানোর সময় সামান্য দুধ ( ১বা ২ চামচ ) দিয়ে ফোটালে গাঁজা হয়ে অশুদ্ধি বা গাদ উপরে ভেসে ওঠে যা তুলে ফেলে দিতে হয়।
এবার আসি চিঁড়াজিরা বা চিকণ চিঁড়ার প্রস্তুত প্রণালীতে

🔴 উপাদান –
〰️〰️〰️〰️〰️
✔️নারকেলের সাদা অংশ
✔️চিনি
✔️যদি ইচ্ছে হয় কয়েকটা ছোটো এলাচ ও
✔️এক চিমটি কর্পূর

🔴 পদ্ধতি –
〰️〰️〰️〰️〰️

১) গঙ্গাজলি বানানোর জন্য যেমন ভাবে নারকেল মালার থেকে সাদা অংশ সাবধানে বের করেছিলেন , ঠিক তেমনি করে নারকেল ছড়িয়ে আদা পেঁয়াজ কোড়ার প্লাস্টিকের কুরুনী দিয়ে পাতলা ও চ্যাপ্টা চিঁড়ের আকারে কুড়ে নিতে হবে।

২) এবার ১:১ অনুপাতে জল ও চিনি মিশিয়ে তাতে আধ থেঁতো করা ছোট এলাচ দিয়ে ঘন চিনির রস বানাতে হবে।

IMG_20180730_164906_HDR

৩) নারকেলের টুকরো গুলো কিছুক্ষণ হালকা গরম জলে ভিজিয়ে রেখে ভালো ভাবে জল ঝরিয়ে নিতে পারেন বা খুব মৃদু আঁচে কিছুক্ষন শুকনো খোলায় নেড়ে নিয়ে ঘন রসে ফেলে নাড়তে হবে।

PSX_20180801_005441

৪) চিনির রসটা এমন গাঢ় হতে হবে যাতে নারকেলের গায়ে টেনে যায়।

৫) এবার একটা বড় থালা বা ট্রের ওপর বিছিয়ে শুকনো করলেই তৈরী বাংলার ঐতিহ্যমণ্ডিত শতাব্দী প্রাচীন মিষ্টি চিঁড়া জিরা বা চিকণ চিঁড়া।

চিঁড়া জিরা বা চিকণ চিঁড়া
চিঁড়া জিরা বা চিকণ চিঁড়া

শুনেছি , আমার দিদিমা দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর রুপোর জাঁতি দিয়ে পাতলা পাতলা করে নারকেল কেটে চিঁড়াজিরা বা চিকণ চিঁড়া বানিয়ে হালকা খয়েরী বর্ডার দেওয়া মোটা সাদা চিনামাটির পাত্রে ভরে রাখত অতিথিসৎকারের জন্য। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই মামাসিদের হাতে সেই মুচমুচে চিঁড়ের সৎকার হয়ে যেত। পুরোনো দিনের মানুষগুলো আর ফিরে আসবে না ঠিকই , কিন্তু তাদের হাতে বানানো সেই সব খাবার আপনারা চাইলেই আবার ফিরে আসবে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : চিনি-কাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহে যাঁরা সাহায্য করেছেন তাঁরা হলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক শ্রী গৌতম বসুমল্লিক এবং শ্রী অমিতাভ পুরকায়স্থ।