গল্প

The earliest bengali cookbook by প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী

আজ কোনো রান্না নয়, শুধু গল্প করতে ইচ্ছে করছে আপনাদের সঙ্গে, এই পরবাসে হঠাৎ করে ‘কথা পেলে’ সেটা লিখে রাখা ছাড়া গতি নেই।

আমাদের মধ্যে অনেকেই পুরোনো দিনের রান্না বা ঠাকুমা-দিদিমার থেকে বংশপরম্পরায় পাওয়া রন্ধন-প্রনালী লিখে ভুয়সী প্রশংসা পেয়ে থাকেন ,
ব্যাপারটা আমার বেশ ভালোলাগে. কিন্তু বরাবরই মনেহয়, ঠিক যে পরিমাণ প্রশংসা বা সম্মান তাঁদের প্রাপ্য ছিল, তা তাঁরা পাননি, দরিদ্র গৃহবধূই হোক বা কোনো সম্ব্রান্ত বংশীয়া, কোনো কোনো দিন হয়তো অর্ধাহারে বা অনাহারে কেটেছে তাঁদের, রান্নার প্রশংসা তো দূরের কথা, তাঁদের নিজের জন্য হাঁড়িতে একুটও ভাত অবশিষ্ট আছে কিনা – সে খবরও কেউ রাখতো না। সকলের জন্য হাসিমুখে উজাড় করে দিতেন নিজের জন্য পরে থাকা শেষ তলানি টুকুও। সংসারে তারা নিজেদের এতোটাই অপ্রয়োজনীয় বলে মনেকরতেন যে কখনো মনেও হয়নি ওই সব মহামূল্যবান রন্ধন-প্রনালী পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিখে রাখবেন।

প্রায় সব পরিবারেই এই একই গল্প হলেও কিছু কিছু পরিবারে একটু ব্যতিক্রমী চিত্র দেখতে পাওয়া যায় ; তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আপামর বাঙালির প্রাণের মানুষ রবি ঠাকুরের পরিবার ; সংস্কার-মুক্ত ব্রাহ্ম সমাজের শিক্ষার আলো এই পরিবারের হেঁশেলের জানলা দিয়ে প্রবেশ করেছিল অনেক দিন আগেই।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ১৪টি সন্তানের মধ্যে তৃতীয় হল হেমেন্দ্রনাথ। রসায়নবিদ হেমেন্দ্রনাথের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মহর্ষির ঘনিষ্ঠ বন্ধু হরদেব চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে নৃপময়ীর। হেমেন্দ্রনাথ ও নৃপময়ীর ১১টি সন্তানের মধ্যে মেজ মেয়ে ‘প্রজ্ঞাসুন্দরী’ ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য মেয়েদের মতই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিণী ছিলেন। সাহিত্য ও সংগীত চর্চার পাশাপাশি তিনি ছিলেন রন্ধন-পটিয়সী; সমকালীন অন্তরপুরবর্তিনী বঙ্গনারীর মতো তার এই বিশেষ প্রতিভা দৈনন্দিন ডাল-ভাত-চচচড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাই তিনি একাধিক রান্নার পদ আবিষ্কারও করেছিলেন। তার তৈরী যেসব পদ সকলের প্রশংসা পেতো, তা তিনি স্বযত্নে লিখে রাখতেন তাঁর খেরোর-খাতায়। সেসময় ঠাকুরবাড়ি থেকে ‘পুণ্য’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো, যার সম্পাদিকা ছিলেন প্রজ্ঞা। তাঁর খেরোর-খাতার অনেক প্রণালী প্রকাশিত হতো এই পত্রিকায়।

Pragyasundari Devi
Pragyasundari Devi

 

আত্মীয় স্বজনদের আপত্তি উপেক্ষা করে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ঠাকুর পরিবারের মেয়ে প্রজ্ঞার বিয়ে হয় আসমিয়া সাহিত্যের জনক লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার সঙ্গে। তারিখটা ছিল ১৮৯১ সালের ১১ই মার্চ। স্বামীর কর্মসূত্রেও হাওড়া, সম্বলপুর ও ঝাড়সুগুদায় গিয়ে থাকতে হয়েছে প্রজ্ঞাকে। এতেই তার সুযোগ ঘটে বিভিন্ন অঞ্চলের রান্না শেখার। তার নিজের সৃষ্ট রান্না গুলির নাম ছিল ভারি অদ্ভুত, যার জন্য বা যে জন্য সেই পদটি তৈরী হয়েছে, তা তার নাম শুনলেই বোঝা যেত, যেমন ধরুন ‘রামমোহন দোল্মা পোলাও’ বা ‘দ্বারকানাথ ফির্নি পোলাও’ কিংবা তার অকালমৃতা মেয়ের নামে তৈরী ‘সুরভি পায়েস’। রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশতম জন্মদিনে তিনি ফুলকপি,খোয়া ক্ষীর, বাদাম-কিশমিশ, জাফরান, সোনা-রুপার তবগ দিয়ে বরফি তৈরি করে তার নাম দিয়েছিলেন ‘কবি সম্বর্ধনা বরফি’। খেয়ে কেউ বুঝতে পারেনি যে সেটি ফুলকপি দিয়ে তৈরি।

 

Laksminath_Bezbaruah
লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া (Lakshminath Bezbaruah)

প্রজ্ঞার সাহিত্যানুরাগী, ভোজনরসিক স্বামীর পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর লেখা রন্ধন-প্রনালী গুলি প্রথমবার ছাপার অক্ষরে রান্নার বই হিসেবে প্রকাশিত হয় ১৩০৭ বঙ্গাব্দে, ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার’ (প্রথম খণ্ড)। যদিও প্রথম খণ্ডটি ছিল সম্পূর্ণ নিরামিষ রান্না নিয়ে লেখা ; আর এই বইটিই বোধহয় কোনো বঙ্গনারীর লেখা, বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম ‘রান্নার বই’।

 

Amish o Niramish Ahar

 

আমার এই লেখাটি তাঁর এবং , তাঁর মতো সেকালের সমস্ত অন্ত্যপুরবাসিনী রন্ধন-পটীয়সীদের চরণে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

PSX_20180221_100347