জয় মিত্র কালীবাড়ি
শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে উল্লেখিত শ্রীশ্রীঠাকুরের পদধূলিধন্য কলকাতার কিছু উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান, যেগুলি আজ কালের গভীরে হারিয়ে যেতে বসেছে, তাদের মধ্যে কৃপাময়ীকালি মাতার মন্দির অন্যতম; যা উত্তর চব্বিশ পরগনার অন্তর্গত বরানগরে অবস্থিত। কৃপাময়ী কালীমন্দির জয় মিত্র কালীবাড়ি বা ‘জয়মিত্তির কালীবাড়ি’ নামে সমধিক পরিচিত। শোভাবাজার অঞ্চলের বাসিন্দা শ্রী জয়নারায়ণ মিত্র বা জয় মিত্রের বাবা শ্রী রামচন্দ্র মিত্র কলকাতায় জনৈক জাহাজ ক্যাপ্টেনের বেনিয়ান হিসাবে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। সেই বিপুল সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী জয় মিত্র সেই অর্থে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও সহজাত বৈষয়িক বুদ্ধির জোরে পারিবারিক সম্পত্তি আরও বাড়িয়ে তোলেন। দান ধ্যান আর সামাজিক কাজেও উনি প্রচুর অর্থ ব্যায় করেন। শোভাবাজার অঞ্চলে তাঁর নামে রাস্তায় আছে ‘জয় মিত্র ঘাট লেন’।
দক্ষিণেশ্বরে রানি রাসমণি কতৃক মা ভবতারিণীর কালীমন্দির প্রতিষ্ঠারও পাঁচ বছর আগে ১৮৫০ সালে জয়নারায়ণ মিত্র বরাহনগর-মালপাড়ার কুঠিঘাট অঞ্চলে (বর্তমান ঠিকানা, ৩৯ হরকুমার ঠাকুর রোড) বারোটি আটচালা শিবমন্দির-সহ কৃপাময়ী কালীমন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
মন্দিরটি নবরত্ন শৈলীর হলেও প্রথাগত নবরত্ন শৈলীর থেকে কিছুটা আলাদা। বাঁকানো চালের পরিবর্তে দেখা যায় দোতলা দালান, মন্দিরের কোণে কোণে চূড়া রয়েছে। মন্দিরের ঠিক সামনে একটি বড় নাটমন্দির ছিল কিন্তু তার ছাদ ভেঙে পড়েছিল বহুকাল আগে। শেষবার যখন গেছিলাম তখন চোখেপড়েছিলো শুধু গোলাকার থামগুলি। বর্তমানে অবশ্য কিছু সংস্কারের কাজ হয়েছে।কয়েক বছর আগে এক প্রোমোটারকে মন্দিরের জমির কিছু অংশ বিক্রি করে দেয় মিত্তির পরিবার। পরিবর্তে মন্দিরটি তিনি সম্পূর্ণ সারিয়ে দিয়েছেন।
বরানগরে কুঠিঘাট থেকে জেলেপাড়ার মাঠ পর্যন্ত রাস্তার নাম হরকুমার ঠাকুর রোড। এখানে পাঁচটা পরপর বিখ্যাত বাড়ি / প্রতিষ্ঠান ছিল যার মধ্যে কয়েকটি এখনো আছে । প্রথমে কুঠিঘাটের সামনেই ভিক্টোরিয়া স্কুল (১৮৬৬) , এখন বন্ধ ।তারপর বরানগর থানার পুরনো বাড়ী যা এখন বি. টি. রোড এ চলে গেছে, এটা তারপর ফাঁড়ি হয়, এখন কিছুই নেই। এর পর একটা লাল রঙের বাড়ি , এটা হোড় – মিলার জুট প্রেস ছিল, ১০০ বছর আগেও রীতিমত রমরমা ব্যাবসা ছিল তবে এখন জবরদখল হয়েগেছে। তারপর একটু ভিতরদিকে P.C. Chandra Chemicals এর কারখানা , এখন বন্ধ, শুধু খাঁচা দেখা যায়। সবশেষ এই জয় মিত্র কালীবাড়ি । এই কালীবাড়ি নিয়েই আজকের লেখা।
আগেই বলেছি , এই মন্দির চত্বরে কয়েকবছর আগে প্রমোটিং শুরু হয় । তারফলে , অনেক কিছু পুরনো জিনিস হারিয়ে গেছে অথবা এমন অবস্থায় আছে, যেটা লোকের নজরে পরেনা । মন্দিরের বাদিকেই একটা শ্বেতপাথরের plaque আছে তাতে একটা পদ্য লেখা। একটু ভালভাবে পড়লে অর্থ উদ্ধার করা যায়। নিচের ছবিতে ওই মন্দিরের যেখানে বলি দেওয়া হত, তার পরিধির ইটের ছবি আছে।

” সিন্ধু-বিন্দু-নেত্র- চন্দ্র পরিমিত সনে ”
অর্থাৎ,
বাংলা সিন্ধু =৭,
বিন্দু=০,
নেত্র=৩,
চন্দ্র=১ ,
অঙ্কশ্য বামাগতি সুত্রে বাংলা ১৩০৭ সালে কুলগুরু বালানন্দ এসেছিলেন, সাথে পূর্ণানন্দ ছিলেন যাঁরা বলির জন্য উৎসর্গীকৃতি জীবের আর্তনাদে বলি বন্ধের বিধান দেন।
ভক্তজন সেই বিধান মেনে বলিপ্রথা বন্ধ করেন। যারা ইচ্ছুক, গিয়ে এই plaqueটা দেখে আসতে পারেন।
শ্রীম রচিত শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত থেকে জানা যায় শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীকে ‘মা’ বলে আর জয় মিত্র প্রতিষ্ঠিত ‘কৃপাময়ী’ ও প্রামাণিকদের ‘ব্রহ্মময়ীকে’ মাসি বলে ডাকতেন; তিনটি বিগ্রহই নির্মাণ করেছিলেন দাঁইহাটের ‘কলির বিশ্বকর্মা” নবীন ভাস্কর। তাই বিগ্রহের মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। প্রথম যেদিন আমি কৃপাময়ী মাকে দেখি, মনে হয়েছিল যেন দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীকেই দেখছি, এতো মিল এই দুটি বিগ্রহের মধ্যে।
বহু প্রাচীন এই মন্দিরে আগে বিভিন্ন পুজো-পার্বনে খুব সমারোহ হত। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আগেকারের সেই জৌলুস আর আড়ম্বর প্রায় শেষ তলানিতে এসে ঠেকেছে। এখনও বারোমাস নিত্যপুজো এবং কালীপুজো হলেও আগের সে রমরমা আর নেই। নাইবা থাকলো জাঁকজমক, মা তো আছেন – মা কৃপাময়ী।ঘুরতে ঘুরতে যান না একদিন পুরোনো কলকাতার ওই অঞ্চলে, কৃপাময়ীমায়ের সঙ্গে দেখা করতে। খুব খারাপ লাগবে না আশাকরি। গঙ্গার পাড়ে শতাব্দী প্রাচীন এক দেউল …. আর আপনি …স্নিগ্ধ বিকেলের পড়ন্ত আলোয় পুরোনো কলকাতার গৌরবময় অতীতে আপনি মুহূর্তের জন্য হলেও পৌঁছে যাবেন।
কিভাবে যাবেন ? বলছি, বি.টি.রোড ধরে সোজা সিঁথির মোর, সেখান থেকে ‘কুঠি ঘাটের অটো’-তে যেখানে নামবেন, সেখান থেকেই দেবদর্শন শুরু; এখানে রয়েছে কুঠিঘাটের দশমহাবিদ্যার মন্দির, শ্রীশ্রীঠাকুর মথুরবাবুর সঙ্গে এই দেবালয় দর্শন করিতে এসে ৺দেবীর ভোগের জন্য মাসিক বন্দোবস্ত করে দিয়াছিলেন। পরবর্তী কালেও তিনি মাঝে মধ্যে এখানে দর্শন করতে আসতেন।দশমহাবিদ্যা-মন্দির কে ডান পাশে রেখে কয়েকপা এগোলেই খেয়া ঘাট (কুঠি ঘাট)। এবার রাস্তাটা ডান দিকে বেঁকে গেছে। ওই রাস্তা ধরে কিছু দূর এগোলেই কলকাতার গৌরবোজ্জ্বল অতীতের সাক্ষী-স্বরূপ ‘জয় মিত্র কালীবাড়ি’।
মাতৃদর্শন সেরে ফেরার পথে একবার বরানগর পাঠবাড়িও ঘুরে আসতে পারেন, খুব দূরে নয়। যদি হাতে বেশ খানিকটা সময় বেশি থাকে তবে কুঠি ঘাট থেকে ভটভটি করে গঙ্গা পেরিয়ে বেলুড়মঠের সন্ধ্যা-আরতি দেখে আসতে পারেন। এতো ঘোরাঘুরির পর ক্লান্ত শরীর আর তৃপ্ত মন নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বরানগর বাজারের কাছে প্রসিদ্ধ ফাগুর দোকানের কচুরী বা চপ সহযোগে উদরপূর্তিটাইবা বাকি থাকে কেন ? এই দোকানের কচুরি ভোজনরসিক ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বড়ো প্রিয় ছিল; কথায় বলে যার শেষভালো তার সব ভালো।
( Photo courtesy : Arindam Das )
মন্দিরের বলিদান বন্ধের ঘটনাটি আমি জেনেছি শ্রী সৌমেন নাথ মহাশয়ের কাছ থেকে।
জয় মিত্র সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন শ্রী অমিতাভ পুরকায়স্থ।
Khub valo laglo….